‘কাজীরা অর্থ-সম্পদ ও শক্তিতে শেখদের সাথে টিকতে পারে নাই’

ঢাকা, জাতীয়

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 20:36:14

‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

কথাগুলো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এই কয়েকটা লাইনের মধ্যেই একটা মানুষের জীবন দর্শন, রাজনীতির প্রেরণা, মনস্তত্ব অবলীলায় উঠে এসেছে। তবুও তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের অনেক কিছুই যেন এখনো মানুষের জানা বাকি রয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে জানার জন্য তাঁর লেখা দুইটি অমূল্য গ্রন্থ আছে। একটি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অন্যটি ‘কারাগারের রোজনামচা’। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ডায়েরির লেখাগুলো সংগ্রহ করে অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে।

২০০৪ সালে হঠাৎ করেই শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে আসে। খাতাগুলি ছিল অতি পুরনো, পাতাগুলি জীর্ণপ্রায় ও লেখা প্রায় অস্পষ্ট। আদতে সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, স্ত্রীর চাপে যা তিনি ১৯৬৭ সালে জেলে বসে লেখা শুরু করেছিলেন। তবে সেটা তিনি শেষ করে যেতে পারেননি বলে নাম দেওয়া হয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বংশ পরিচয়, শৈশব, কৈশোর, শিক্ষাজীবন, তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পারিস্থিতি, দুর্ভিক্ষসহ নানান কিছু।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ বংশে। শেখ বংশের ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট। তবে একসময় তারা ছিল অর্থবিত্তে ধনী, ক্ষমতায় পরাক্রমশালী।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লেখেন- ‘আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। আমার ইউনিয়ন হল ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের পাশেই মধুমতী নদ। মধুমতী খুলনা ও ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করে রেখেছে। আমার জন্মহয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামের এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোরাপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণ স্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে।’

টুঙ্গিপাড়ায় শেখ বংশের পাশেই ছিল কাজী বংশ। শেখদের সঙ্গে কাজীদের যেমন আত্মীয়তা ছিল তেমনি ছিল বহু পুরনা বিরোধ ও তিক্ততার ইতিহাস। নিজের বংশের ইতিহাস শুনে শুনে বড় হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। খুলনা ও ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষের মুখে শোনা যায় শেখ বংশ ও কাজী বংশের বিরোধের ইতিাহাস।

বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ির পাশেই আরেকটা পুরানা বংশ আছে, যারা কাজী বংশ নামে পরিচিত। এদের সাথে শেখদের আত্মীয়তা আছেও। আত্মীয়তা থাকলেও রেষারেষি কোনোদিন যায়নি। কাজীরা অর্থ-সম্পদ ও শক্তিতে শেখদের সাথে টিকতে পারে নাই, কিন্তু লড়ে গেছে বহুকাল। যে কাজীদের সাথে আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল তারা শেখদের সমর্থন করত। কাজীদের আরেকটা দল রাণী রাসমণির সাথে যোগদান করে। তারা কিছুতেই শেখ দের আধিপত্য সহ্য করতে পারছিল না। তাই তারা এক জঘন্য কাজের আশ্রয় নিল শেষ পর্যন্ত। অধিকাংশ কাজী শেখদের সাথে মিশে গিয়েছিল। একটা দল কিছুতেই শেখদের শেষ না করে ছাড়বে না ঠিক করেছিল।’

‘বৃদ্ধ এক কাজী তার নাম সেরাজতুল্লা কাজী। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। ছেলেরা এক ষড়যন্ত্র করে এবং অর্থের লোভে বৃদ্ধ পিতাকে গলা টিপে হত্যা করে শেখ বাড়ির গরুর চালের উপর রেখে যায়। এ ঘটনা শুধু তিনভাই ও একবোন জানত। বোনকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়েছিল। শেখ বাড়িতে লাশ রেখে রাতারাতি থানায় যেয়ে খবর দেয় এবং পুলিশ সাথে নিয়ে এসে লাশ বের করে দেয় এবং বাড়ির সকলকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়। এতে শেখদের ভীষণ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়।’

‘আমার দাদার চাচা এবং রেণুর দাদার বাবা কলকাতা থেকে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে চলে আসেন বাড়িতে। কলকাতার সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। তারপর যখন সকলে গ্রেফতার হয়ে গেছে , দেখার কেউ নেই-বড় বড় ব্যবসায়ী,মাঝি ও ব্যাপারীরা নৌকা ডুবিয়ে উধাও হতে শুরু করল। এর পূর্বে তমিজুদ্দিনের খুনে যথেষ্ট টাকা খরচ হয়ে গেছে। জমিদারিও নিলাম হয়ে প্রায় সবই চলে যেতে লাগল।বহুদিন পর্যন্ত মামলা চলল।নিচের কোর্টে সকলেরই জেল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টে মামলা শুরু হল।আমাদের এডভোকেট হাইকোর্টে দরখাস্ত করল সিআইডি দ্বারা মামলা আবার ইনকোয়ারি করাতে। কারণ এ মামলা ষড়যন্ত্রমূলক।’

‘হাইকোর্ট মামলা দেখে সন্দেহ হলে আবার ইনকোয়ারি শুরু হল। একজন অফিসার পাগল সেজে আমাদের গ্রামে যায় আর খোঁজ খবর নেয়। একদিন রাতে সেরাজতুল্লা কাজীর তিন ছেলের মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয় এবং কথায় কথায় এক ভাই অন্য ভাইকে বলে, বলেছিলাম না শেখদের কিছু হবে না,বাবাকে অমনভাবে মারা উচিত হবে না। অন্যভাই বলে, তুইতো গলা টিপে ধরেছিলি তাই বাবা মারা গেল’। বোনটা বলল, বাবা একটু পানি চেয়েছিল, তুই তো তাও দিতে দিলি না।’ সিআইডি এই কথা শুনতে পেল তাদের বাড়ির পিছনে পালিয়ে থেকে। তার কয়েকদিন পরেই তিনভাই ও বোন গ্রেফতার হল এবং স্বীকার করতে বাধ্য হল তারাই তাদের বাবাকে হত্যা করেছিল।’

‘শেখরা মুক্তি পেল আর ওদের যাবজ্জীবন জেল হল। শেখরা মামলা থেকে বাঁচল কিন্তু সর্বশান্ত হয়েই বাঁচল। ব্যবসা নাই, জমিদারি শেষ, সামান্য তালুক ও খাস জমি,শেখ বংশ বেঁচে রইল শুধু খাস জমির জন্য। এদের বেশ কিছু খাস জমি ছিল।আর বাড়ির আশপাশ দিয়ে কিছু জমি নিষ্কর ছিল। খেয়ে পরার কষ্ট ছিল না বলে বাড়িতে বসে আমার দাদার বাবা-চাচারা পাশা খেলে দিন কাটাতেন।’

তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী

এ সম্পর্কিত আরও খবর