সৌদিতে নিযার্তিতদের আর্তনাদ পৌঁছায় না বাংলাদেশ দূতাবাসে!

, জাতীয়

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | 2023-12-27 20:04:31

ঢাকা: ভাঙা হাত-পা নিয়ে তিন মাস সৌদিতে পড়ে আছে আমার মেয়ে। সরকার ও দূতাবাস কারও কাছে একটু সাহায্য পাচ্ছি না। প্রতিদিন ফোন করে, ‘আব্বা আমাকে নিয়ে যাও, নিয়ে যাও’-কান্নাকাটি করে।

তিন মাস হলো প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, ফেরত আনার উদ্যোগ তো দূরের কথা, একটিবারের জন্য খোঁজও নেয়নি দূতাবাস ।

‘অভাবে পড়ে মেয়েরে সৌদি পাঠাইছি এটাই কি আমার দোষ?’- বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে সৌদিতে নিযার্তিত গৃহশ্রমিক আনোয়ারার বাবা আনিছ মিয়ার।

কেরানীগঞ্জের দিনমজুর আনিছ মিয়ার পাঁচ সদস্যের পরিবার। অভাবের সংসারে খরচ চালাতে যখন নাভিশ্বাস অবস্থা আনিছ মিয়ার, ঠিক তখনই ‘সৌদি অফার’ নিয়ে সামনে আসে দালাল।

 

দালালের দেখানো লোভে আনোয়ারাকে সৌদি পাঠায় আনিছ। এক মাস পরই নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। সূদর সৌদিতে মেয়ে বিপদে রয়েছেন শুনে ‘বাজ’ পড়ে বাবার মাথায়। অসহায় বাবা একবার ছুটছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, তো আরেকবার যাচ্ছেন ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারে।

অভিবাসন সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাগুলো জানায়, গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সৌদি গৃহকর্তার হাতে যৌন হেনস্তা, শারীরিক নিযার্তিনের মুখে দেশে ফিরছেন নারী শ্রমিকরা। এর মধ্যে অনেকেই নৃসংশতার শিকার হয়ে দূতাবাসের সেফস হাউজ, হাসপাতাল, সফর জেল ও মক্তবে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ মাসের পর মাস ধরে দেশের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু তাদের ফিরে আসার এ ‘আর্তি’ সরকার, দূতাবাস কিংবা সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর কর্ণপাত হচ্ছে না।

হেনস্তার শিকার এসব নারীর বাবা-মা, স্বামী-সন্তানসহ আত্মীয়রা দেশে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় দিন পার করছেন। অনেকেই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করেও পাচ্ছেন না কোনো প্রতিকার।

আনিছ মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এ বছরের জানুয়ারিতে আনোয়ারা সৌদি যায়। সৌদি মালিকের বাসা গৃহকর্মী কাজ পায়। গৃহকর্তার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে মেরে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর একটু সুস্থ হয়ে আনোয়ারা সফর জেলে রয়েছেন।’

সফর জেলে আনোয়ারা রয়েছেন আরও বিপদে। যে এজেন্সির মাধ্যমে সে সৌদি গিয়েছিলো, সেই এজেন্সির লোকজন তাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। লোক মারফত দূতাবাসে জানালেও, তার মেয়ে কোন সাহায্য পায়নি, বললেন আনিছ।

সৌদিতে আনোয়ারার মতো বিপদে রয়েছেন আরো প্রায় একশ নারী শ্রমিক। দূতাবাসের সেইফ হাউসে স্থান না পেয়ে দেশটির মক্তব, সফর জেল ও হাসপাতালে অসহায় দিনাতিপাত করছেন তারা। এ দলেরই যাত্রাবাড়ি দয়াগঞ্জের তানিয়া, নীলক্ষেতের রানু বেগম এবং নরসিংদীর আছিয়া।

সৌদি যাওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় ভয়াবহ নৃসংশতার শিকার দয়াগঞ্জের তানিয়া। অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মালিক দোতলা বাড়ি থেকে ফেলে দেয়। হাত-পা ভেঙ্গে গেলে পরে চিকিৎসার জন্য কিং হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

তানিয়ার স্বামী রাছেল বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু এখনও কোনো খবর পাইনি। যে এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছে তারা বলেছে আজ আসবে, কাল আসবে, টাকাও চাচ্ছে আনার জন্য। খুব দু:শ্চিন্তা হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যে জানা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ নারী কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে দুই লাখই গেছেন সৌদি আরবে। নির্মমতার মুখে চলতি বছরেই প্রতিমাসে গড়ে ২০০ করে নারী শ্রমিক সৌদি থেকে দেশে ফিরছেন।

 

ব্রাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, সৌদি আরবে কত জন নিযার্তিত হয়েছেন, নিযার্তিত হওয়ার পরও সহযোগিতার অভাবে দেশে ফিরতে পারছে না সেটির সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। নির্যাতনের মুখে ফিরে আসাদের চিত্র দেখলে সেখানকার পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায়।

প্রতিকারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতনসহ সব হচ্ছে বাংলাদেশের নারীদের সঙ্গে। যারা নির্যাতন করে তাদের বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এজন্য দূতাবাসকে প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস বার্তা২৪.কমকে বলেন, কোনো প্রবাসী বা তার পরিবার অামাদের সাথে যোগাযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে দূতাবাসকে জানিয়ে দেই। দূতাবাস নির্যাতিত শ্রমিককে সেইফ হোমে নিয়ে অাসে। যদি প্রয়োজন হয় তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তবে দূতাবাস শতভাগ সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না।

অামরা প্রতিদিন ফোন দিচ্ছি, স্বজনদের সঙ্গে অ্যাবিউসড নারী শ্রমিকের কথা বলিয়ে দিচ্ছি। ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অাইনের মারপ্যাচের কারণে ঝামেলা হয়- বলে জানান তিনি।

এছাড়া শ্রমিক অানোয়ারার বিষয়ে তিনি জানান, অানোয়ারার বাবা অামাদের কাছে প্রায় অাসে। তার সঙ্গে অাজকেও কথা হয়েছে। তাকে দেশে অানতে চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর