ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন ‘ভরত রাজার দেউল’ থেকে

ঢাকা, জাতীয়

মো. আলকামা, জাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 11:04:13

খুলনা-যশোর সীমান্তে কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ভরত ভায়না গ্রাম। নদী আর সবুজ বৃক্ষ আবৃত্ত এই গ্রাম ও এলাকা যে কারো মন কেড়ে নিবে। তবে শুধু সবুজ গাছ আর নদী নয় ভ্রমণ প্রেয়সী মানুষদের জন্য এখানে রয়েছে আরো মূল্যবান একটি স্থান। যেখানে ভ্রমণকারীরা মহাস্থানগড়ের কিছুটা স্বাদ নিতেও পারেন। খুলনা-যশোর সীমান্তবর্তী ভরত ভায়না গ্রামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৮শ বছর পূর্বের এক পুরাকীর্তি। শতবর্ষী বিরাট বটগাছের নিচে অবস্থিত এ পুরাকীর্তিটি স্থানীয় জনপদের কাছে ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত।

প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক কাশীনাথ দীক্ষিত ভরত ভায়না ঢিবি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রাথমিক জরিপ কাজ চালান ১৯২২-২৩ সালে। পরবর্তীতে মোট তিন দফায় ১৯৮৪-৮৫, ১৯৯৬-২০০১ এবং সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন কাজ পরিচালনা করে।

প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এখানকার ব্যবহৃত ইট ও প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন এটি খ্রিষ্টীয় সাত থেকে নয় শতকে নির্মিত একটি মন্দির। ক্রুশাকৃতির এই মন্দির খ্রিষ্টীয় সাত শতকের পরে পূর্ব ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যর বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। মন্দির স্থাপত্যর পরিভাষা অনুসারে এ ধরনের মন্দির সর্বতভদ্র শৈলীর বলে চিহ্নিত করেছেন তারা। সোমপুর, মহাবিহার, শালবন বিহার, ‍বিক্রমশীলা এবং মহাবিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের ভূমি নকশা এই মন্দিরের অনুরূপ। পরবর্তী সমেয়ে এই মন্দির স্থাপত্য গঠন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ মন্দির স্থাপত্যকে প্রভাবিত করেছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমদিকের বদ্বীপ অঞ্চলে এটিই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র সর্বোতভদ্র ধরনের মন্দির।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯২৩ সালে কাশীনাথ দীক্ষিত ঢিবি জরিপ পরিচালনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে ঢিবির নিচে পাঁচ শতকের প্রাচীন একটি বৌদ্ধমন্দির আছে এবং এটি সম্ভবত হিউয়েন-সাং বর্ণিত সমতটের ৩০টি সংঘারামের একটি। সে সময় তিনি কিছু সীমানা পিলারও দেন। সুযোগসন্ধানী মানুষ বিভিন্ন সময়ে সেই সব মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে। প্রাচীন মন্দিরটি ভরত নামধারী এক প্রভাবশালী রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত। অনুমিত মূল মন্দিরটি ১ একর ২৯ শতক জমির ওপর অবস্থিত। চারদফায় খননের ফলে স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় যে স্থাপনাটির উপরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানের দৃশ্যমান অংশ সম্ভবত বিনষ্ট হওয়া অট্টালিকার ভিত্তি বা উঁচু মঞ্চ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের করা স্কেচ থেকে দেখা যায়, মোট ৮২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ ধাপে ধাপে ওপরের দিকে উঠে গেছে। ঢিবির শীর্ষ ধাপটির দেয়াল ৯ ফুট প্রশস্ত। এর মধ্যে ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থের বর্গাকৃতির চারটি প্রকোষ্ঠ আছে। মূল অট্টালিকার প্রধান কক্ষটি এই প্রকোষ্ঠের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/12/1565618115322.jpg

দ্বিতীয় ধাপের দেয়াল ৩ ফুট চওড়া, এখানে বিভিন্ন আকৃতির ১৯টি প্রকোষ্ঠ আছে। ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া দেয়ালের তৃতীয় ধাপে প্রকোষ্ঠ ১৮টি। সাড়ে ৩ ফুট চওড়া দেয়ালের চতুর্থ ধাপটিতে ১৯টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। শেষ ধাপে ১০ থেকে ১৩ ফুট চওড়া দেয়ালের মধ্যে ২২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। তার নিচে প্রায় ১০ ফুট চওড়া প্রদক্ষিণ পথ আছে। মূল মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশপথ। এগুলোর মধ্যেও এখন পর্যন্ত সাতটি প্রকোষ্ঠ দেখা গেছে। গঠনশৈলী বিবেচনায় পূর্ব দিকটাই এর মূল প্রবেশপথ ছিল বলে ধারণা করা হয়। এর নির্মাণে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তার পরিমাপ ৩৬ সেন্টিমিটার, ২৬ সেন্টিমিটার ও ৬ সেন্টিমিটার। এত বড় ইট এই অঞ্চলের কোনো পুরাকীর্তিতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি।

 

স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও গুপ্তযুগের একটি পোড়ামাটির মাথা, পোড়ামাটির মানুষের হাত ও পায়ের কয়েকটি ভগ্ন টুকরা, কয়েকটি মাটির প্রদীপ, অলংকৃত ইটের টুকরা, পদচিহ্ন-সংবলিত দুটি ইটের টুকরা এবং একটি মাটির ক্ষুদ্র পাত্র সংগৃহীত হয়েছে, যা খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে যাওয়ার জন্য পানি পথে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। স্থল পথে যেতে হলে দুই মাধ্যমে যেতে পারেন ট্রেন অথবা বাসে। ট্রেনে যেতে হলে প্রথমে খুলনা যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে খুলনা অঞ্চলে বহুল চলিত মাহিন্দ্রা নিয়ে মহসিন মোড়ে নামতে হবে (ভাড়া ২৫ টাকা)। অথবা সরাসরি ঢাকা থেকে বাসে এসে মহসিন মোড় নামতে পারেন সেক্ষেত্রে বাড়তি রাস্তা এড়ানো যাবে। তারপর সেখান থেকে আবারো মাহিন্দ্রাতে শাহপুর বাজার আসতে হবে (ভাড়া ২৫ টাকা)। শাহপুর থেকে ভ্যান অথবা অটোতে যেতে হবে তবে মনে রাখা দরকার ভ্যান অথবা অটো চালকদেরকে ভরতের দেউল বললে না চিনতে পারে সেক্ষেত্রে ভর্তের দেল বলতে হবে। শাহপুর বাজার থেকে সরাসরি আপনাকে ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউলে নামিয়ে দিবে (ভাড়া ২০ টাকা)।

আবার ঢাকা থেকে সাতক্ষীরাগামী বাসে করে খুব সহজে আসতে পারেন সেক্ষেত্রে চুকনগর বাজারে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে মাহিন্দ্রা করে সরাসরি ভরতের দেউল (ভাড়া ২০ টাকা)।

কোথায় খাবেন

পুরাকীর্তি ঘিরে এখনো তেমন কোন খাবার হোটেল গড়ে উঠেনি। এছাড়া গ্রাম্য এলাকা হওয়ার কারণে তেমন কোন হোটেল বা রেস্ট্রুরেন্ট নেই। তবে ফেরার পথে চুকনগরের বিখ্যাত আব্বাসের হোটেল থেকে চুইঝালের খাসির মাংশ খেয়ে আসতে পারেন।

কোথায় থাকবেন

আশপাশে থাকার কোনো হোটেল নেই। সবচেয়ে ভালো হয় খুলনা ফিরে কোনো একটা হোটেলে রাতে থাকলে। সেই সাথে সন্ধ্যায় খানজাহান আলী সেতু থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এছাড়া খুলনার আরো বিখ্যাত স্থানসমুহে এক নজর ফেলে আসতে পারেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর