বিয়ে-সুন্নতে খৎনায় ব্যবহার হচ্ছে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ‘বড়কুঠি’!

রাজশাহী, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, রাজশাহী | 2023-08-29 02:04:19

রাজশাহী মহানগরীর বড়কুঠি ভবনের সামনেই প্রবেশপথের পাশে একটি সাইনবোর্ড রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের। এতে লেখা রয়েছে-‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি, কোনো ব্যক্তি এ পুরাকীর্তির কোনো অংশ ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে অথবা এর কোনো বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ ঘটালে বা এর কোনো অংশের ওপর কিছু লিখলে বা খোদাই করলে বা কোনো চিহ্ন বা দাগ কাটলে ১৯৬৮ সালের ১৪ নম্বর পুরাকীর্তি আইনের ১৯ ধারায় সর্বাধিক এক বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

অথচ শুক্রবার (৩০ আগস্ট) বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি ধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে গেল রাজশাহীর সর্বপ্রাচীন দালান ‘বড়কুঠি’তে। দিনভর প্রাচীন এ পুরাকীর্তির ভেতর চুলা বসিয়ে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সবই হলো। ভবনটির নিচতলা ব্যবহার করে অনুষ্ঠিত হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কর্মচারী ছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের কেউই বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন।

বড়কুঠি এলাকার বাসিন্দা মো. আলমের মেয়ে মিমি খাতুনের বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতাই সেখানে হয়। বর রুবেল হোসেনের বাড়ি নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকায়। পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী। আর মিমির বাবা আলম রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একজন কর্মচারী।

শুক্রবার বিকেলে বড়কুঠির সামনে গিয়ে দেখা যায় বিয়ের জন্য নির্মাণ করা গেট। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই পশ্চিম দিকে চোখে পড়ল চুলা জ্বালিয়ে রান্না করার দৃশ্য। আর পূর্ব দিকে ধুয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে খাবারের থালা। উচ্ছিষ্ট খাবার পড়ে ছিল সেখানে। মূল ভবনের ভেতরে ঢুকতেই যে কক্ষ, সেখানে করা হয়েছিল কনের বসার স্থান। এ কক্ষটি পার হয়ে ভেতরে গেলেই ‘পাঠকক্ষ’ নামের একটি কক্ষ। চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে সেখানে চলছিল খাওয়া-দাওয়া। আর ‘তাসকক্ষ’ নামের আরেকটি কক্ষে রান্নার পর রাখা হয়েছিল খাবার। এছাড়া পাশের আরেকটি কক্ষে করা হয়েছিল বর রুবেল হোসেনের বসার স্থান। পুরো বড়কুঠি ভবনের নিচতলা ছিল লোকে লোকারণ্য। ঠিক কমিউনিটি সেন্টারের মতোই ব্যবহার হলো প্রাচীন এই ভবনটি।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ডাচরা রাজশাহী শহরে রেশম ও অন্যান্য জিনিসের ব্যবসা শুরু করে। ওই শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময় তারা বড়কুঠি নির্মাণ করে। ব্যবসায়ীদের কাছে ‘ডাচ্ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে পরিচিত এ স্থাপনাকে স্থানীয়ভাবে ‘বড়কুঠি’ বলা হয়। আশপাশের সব নীলকুঠির মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় বা মর্যদা সম্পন্ন হওয়ায় এর নাম হয়েছিল বড়কুঠি। বড়কুঠি নির্মাণকালে এর চেয়ে বড় কোনো ভবন রাজশাহী শহরে ছিল না।

দেশভাগের পর ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে বড়কুঠি সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং খাদ্য বিভাগের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে বড়কুঠি বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় তার বর্তমান অবস্থানে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বড়কুঠি উপাচার্যের কার্যালয় ও বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বড়কুঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্লাব রয়েছে। সম্প্রতি এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রক্রিয়াটি এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি।

বড়কুঠির দেখাশোনার জন্য এর নিচতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন প্রহরী গোলাম মোর্তজা চান্দু। দু’টি কক্ষ তিনি ব্যবহার করেন। এর একটি ‘ক্রীড়া কক্ষ’ তার শোবার ঘর। মোর্তজার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন মো. বাবলুও বড়কুঠির দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। তবে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন বড়কুঠি ভবনের সামনের মহল্লায়। এ দুই কর্মচারী বড়কুঠিতে বিয়ের অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছেন।

বিষয়টি স্বীকার করে কনের বাবা মো. আলম বলেন, ‘বড়কুঠিতে এর আগেও বিয়ে ও সুন্নতে খৎনাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে। এজন্য মাত্র এক হাজার টাকা ভাড়া লাগে। তিনি বাবলু ও মোর্তজার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন।’

জানতে চাইলে বড়কুঠির প্রহরী গোলাম মোর্তজা বলেন, ‘ভবনটিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ক্লাব রয়েছে। বিয়ে, সুন্নত খৎনা, জন্মদিন, মুখে ভাতের যেসব অনুষ্ঠান এখানে করতে দেওয়া হয়, তা থেকে প্রাপ্ত টাকা কর্মচারী ক্লাবের তহবিলে জমা করা হয়। আমরা নেই না।’

তবে প্রত্মতত্ত্ব অধিদফতরের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘এতো প্রাচীন স্থাপনায় ব্যক্তিগত বা সামাজিক অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেওয়া অকল্পনীয়। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে একটি পুরনো মিলনায়তন আছে। প্রাচীন ঐতিহ্য বলে সেখানেই আমরা কোনো অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেই না। আর রাজশাহীর বড়কুঠি তো আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একজন কর্মকর্তা পাঠিয়ে এ বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’

বড়কুঠিতে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এমএ বারী বলেন, ‘ভবনটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই প্রত্মতত্ত্ব অধিদফতর সেখানে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে। এ অবস্থায় ভবনটি দেখাশোনার জন্য জেলা প্রশাসনেরও দায়িত্ব রয়েছে।’

তবে জেলা প্রশাসক হামিদুল হক জানান, বড়কুঠি এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকায় এর যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটি তাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে। তারপরেও তিনি এ বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা বলবেন। ভবনটির যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর