শিশু নওশিনের প্রশ্ন, ‘বাবা তোমার হাত নেই কেন?’

ময়মনসিংহ, জাতীয়

উবায়দুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 23:03:58

৫ বছর বয়সী শিশু সন্তান ইসরাত জাহান নওশিন, পঙ্গু বাবার পাশে বসে ঢুকরে কাঁদছে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতেও তাকিয়ে থাকে শয্যাশায়ী বাবার দিকে। ক্ষণে ক্ষণে প্রশ্ন করে, বাবা তোমার একটি হাত নেই কেন?

সন্তানের এমন প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই হতভাগ্য ইলিয়াস নোমানের। ডান হাতে সন্তানকে বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি! বলতে থাকেন, মামনি ওরা আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমার আল্লাহ করবেন ওদের বিচার! বাবা-কন্যার এমন আবেগঘন সংলাপে কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্ত্রী মাহমুদা আক্তার।

জীবন নামের বহতা নদীর মাঝপথে এসে চিরদিনের জন্য স্বামীর এক হাত হারানোর কঠিন বাস্তবতা যেন তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

বলা হচ্ছে ময়মনসিংহ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য ইলিয়াস নোমানের (২৯) কথা। সপ্তাহ দুয়েক আগে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার শিবগঞ্জ এলাকায় স্থানীয় যশরা ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক সুমনের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসীর নৃশংস হামলার শিকার হন তিনি। এখন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের ২১৭ নম্বর কেবিনের বিছানায় ঠাঁই হয়েছে তার।

নোমান প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের চাচাতো বোনের ছেলে ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার নাতি।

সন্ত্রাসীদের নৃশংসতার শিকার ইলিয়াস নোমান

 

নিজ গ্রামের পাশের খোদাবক্সপুর গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের নাম করে নিরীহ প্রায় ৩০ জন গ্রামবাসীর কাছ থেকে যুবলীগ নেতা সুমন সিন্ডিকেট দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সেই টাকা নেওয়ার প্রতিবাদ এবং গ্রামবাসীকে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে সহায়তা করায় ওই সন্ত্রাসীদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন রাজনীতির পাশাপাশি ঠিকাদারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ইলিয়াস নোমান।

রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের সঙ্গে আলাপে কাঁদতে কাঁদতে ইলিয়াস নোমান বলেন, ‘ওদের অনেক মিনতি করে বলেছি, আমার সন্তান আছে। আমাকে মেরো না। ওরা শুনেনি। ওরা আমাকে হত্যা করতেই সারা শরীরে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। আমার বাম হাত কেটে নিয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবেই ওরা সটকে পড়েছে। আমার চিৎকারেও কেউ এগিয়ে আসেনি।’

কী ঘটেছিল সেদিন, সেই বর্ণনা জানতে চাইলে নিজেকে স্বাভাবিক করে ইলিয়াস নোমান বলেন, ‘গত সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) গফরগাঁও উপজেলার শিবগঞ্জ বাজার এলাকার পাশের একটি বাঁশঝাড়ে সন্ত্রাসীরা তাঁর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। আমি শিবগঞ্জ বাজার থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম’।

ওই এলাকার একটি বাঁশঝাড়ের কাছে আসার পর পরই আমাকে লক্ষ্য করে ওরা ঢিল ছুঁড়তে থাকে। সেই ঢিলে আমি মোটরসাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে যাই। তাৎক্ষণিক চাপাতি, রামদা, লোহার পাইপ ও রড দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে তারা। ওদের এলোপাতাড়ি কোপ আমার হাতে-পায়ে ও মুখে লাগে।

আমি বেঁচে আছি না কী মরে গেছি সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। এরপর সন্ত্রাসী রাকিব, সুমন, ফয়সাল, মাহফুজ, ওলাদসহ ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী চাপাতি ও রামদা দিয়ে আমার সারা শরীরে কোপাতে থাকে। এরপর তাঁরা আমার বাম হাতে রামদা দিয়ে কয়েকটি কোপ দিলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে দেখি আমার বাম হাত আর নেই।’

খোদাবক্সপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মুখে হাসি ফোটাতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, গ্রামকে আলোকিত করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছিলেন। সেই গ্রামে এখন আলোকিত হয়ে উঠেছে ঠিকই। কিন্তু ইলিয়াস নোমানের পরিবারের আলো যেন নিভে গেছে নিমিষেই। তাদের চোখে-মুখে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত।

জীবনের এমন কঠিন বাস্তবতায় সেই খুশির খবর ইলিয়াস নোমানের কণ্ঠে, বলেন, ‘ওরা আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমি হাত হারালেও খোদাবক্সপুর গ্রামের বাসিন্দারা বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছেন।’

সংকটাপন্ন ইলিয়াস নোমান জানান, সেদিন তাকে প্রথমে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর তাঁর বাম হাত কেটে ফেলা হয়েছে।

তিনি বলেন ‘এ ঘটনার পর আমার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার সন্ত্রাসী সুমনসহ ১০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ এখনও কোনো আসামিকে গ্রেফতার করছে না। আমি আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যাতে করে ওরা আর কারো জীবনে এমন ক্ষতি করতে না পারে।’

এ বিষয়ে গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অনুকূল সরকার বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটার পর আমি এই থানায় যোগদান করেছি। ঠিক কী কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মামলা দায়েরের পর ইতোমধ্যেই সারোয়ার জাহান ওরফে ধনু নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অন্যরা পলাতক রয়েছেন। তাদেরকেও গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর