মহিলা বাসে দুর্ভোগের যাত্রা

ঢাকা, জাতীয়

নাজমুল হাসান সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম ঢাকা | 2023-12-13 21:40:11

সময় গত বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট। রাজধানীর ফার্মগেটের ওভার ব্রিজের নিচে বিভিন্ন বাসের কাউন্টার ও ফাঁকা জায়গায় অসংখ্য যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসের অপেক্ষায়। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস হওয়ায় সবার মাধ্যে কর্মস্থলে পৌঁছানোর তাড়া ছিল। এক একটা গাড়ি যাত্রী বোঝাই করে আসছে, স্টপেজে কয়েকজনকে নামিয়ে আরও নতুন যাত্রী তুলে চলে যাচ্ছে। ভিড় থাকায় অনেকেই আবার গাড়িতে উঠতেও পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে বেশি বেকায়দায় পড়েন নারী যাত্রীরা।

ওইদিন ফার্মগেটের পুলিশ বক্সের ধারে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, দুই নারী যাত্রীকে। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তারা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক গাড়িতেই তারা উঠলেন না। কৌতুহল নিয়ে কারণ জানতে চাইলে সামান্তা নামে এক নারী বলেন, ‘আমরা বিআরটিসি মহিলা বাসের নিয়মিত যাত্রী। ওই বাসের অপেক্ষা করছি।’

সাথে থাকা অন্তি আজমিরা জানালেন, সকাল আটটা ত্রিশ মিনিটে বাস আসার কথা থাকলেও ৮টা ৫০ পার হচ্ছে, এখনও বাস আসেনি। তাই বাস না আসলে অন্য বাসেই অফিসে যেতে হবে।

পাশে থাকা কয়েকজন নারী যাত্রীরা জানান, প্রায় দিনই মহিলা সার্ভিসের বাস বিশ মিনিট দেরিতে আসে। অনেক সময় অন্য বাসে অফিসে যাওয়া লাগে। মতিঝিলগামী সরকারি কর্মচারী ঝর্ণা আক্তার বলেন, ‘গাড়ি আসলেও কখনো কখনো অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে বাসে ওঠা যায় না। আবার কখনও কখনও গাড়িতে ভিড় না থাকায় একমাত্র যাত্রী হয়ে মতিঝিল গিয়েছি। অনেকদিন ধরে এই গাড়িগুলো চলছে। প্রায় সব বাসই ধীর গতির হয়ে গেছে। তাছাড়া গাড়িতে ফ্যান না থাকায় গরমে যাতায়তে কষ্ট হয়। আর গ্লাস ভাঙা থাকায় বৃষ্টির পানিতে ভিজে যেতে হয়।’

এরই মধ্যে আটটা বেজে আটান্ন মিনিটে একটি ‘মহিলা বাস’ এসে থামে ফার্মগেটে। ওই বাসে আগে থেকেই যাত্রী বেশি থাকায় অল্প সংখ্যক যাত্রী নিয়েই রওনা করে দ্রুত। অনেকেই উঠতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে অন্য গাড়ি ধরে চলে যান। আবার অনেকে অপেক্ষা করেন দ্বিতীয় বাসের জন্যে। ৯টা ১৫ মিনিটে দ্বিতীয় বাসটি অর্ধেক ফাঁকা আসন নিয়ে এসে দাঁড়ায়। এসময় মাত্র তিনজন যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে রওনা করতে হয় বাসটিকে।

সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ১২টি বিআরটিসি আর বেসরকারিভাবে পরিচালিত দোলনচাঁপাসহ মোট ১৬টি বাস নারীদের জন্য বিশেষ সেবা দেয়। এর মধ্যে বিআরটিসি’র মিরপুর-১২ নাম্বার ডিপোতে মহিলা কন্ডাক্টর না থাকায় সেবা বন্ধ, মোহাম্মপুরের বাস দুটিতে ছোট বাচ্চা নিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছে, মতিঝিল ডিপোর ৫টি বাসে মোটামুটি সেবা দেওয়া হয়। তবে মাঝে মাঝে মহিলা কন্ডাক্টর না আসায় সেবা বন্ধ রাখতে হয়। তবে কল্যাণপুর ডিপোর বাস দুটি নিয়মিত চলে। আর জোয়ারসাহারা ডিপোর বাস দুটিও মহিলা কন্ডাক্টরের অভাবে বন্ধ আছে।

যাত্রীদের অভিযোগ আর ভোগান্তির বিষয়ে কল্যাণপুর ডিপো থেকে আজিমপুর রোডে চলাচল করা ‘মহিলা বাস সার্ভিসে’র চালক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘প্রথমত মহিলা বাস সার্ভিস সরকারের একটি লস প্রজেক্ট। তাই এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা উদাসীন। অফিস শুরু ও শেষের সময় শুধু এই সেবা দেওয়া হয়। মূলত যানজটের কারণে টাইমিং মিস করি। ফলে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন। এমনকি আমাদেরও সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ মহিলা যাত্রী না পাওয়ায় ফাঁকা গাড়ি নিয়েই যেতে হয়। আর গাড়ি ফাঁকা গেলে এটার রাজস্ব কন্ডাক্টরকে পরিশোধ করতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি গাড়ির জন্যে দিনে ১৮০০-৩৬০০ টাকার রাজস্ব দিতে হয়। তাছাড়া টাইমিং মেলানোর জন্য দ্রুত যেতে চাইলে সার্জেন্টরা পাঁচ হাজার টাকার মামলাও দেন। ২০১২ সাল থেকে বাসগুলো চললেও নিয়মিত সার্ভিসিং করানো হয় না। ফলে ফ্যান নষ্ট এবং অনেক গ্লাস ভাঙা। গত এক বছর ধরে গাড়ির ফ্যান ও গ্লাস মেরামতের আবেদন করা হলেও সংশ্লিষ্টরা মেরামত করছেন না।’

আজিমপুর রোডে চলাচল করা ‘মহিলা বাস সার্ভিস’র কন্ডাক্টর দিলারা বলনে, ‘আমি কিছু কইতে পারমু না। খালি আপনেরে না, ম্যালা টিভিতেও কইছি আমাগো কথা কিন্তু কোনো কাম হয় নাই।’

কল্যাণপুর ডিপোর নারী কন্ডাক্টর সুমি বলেন, ‘আমরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করি। এক দিনে হাজিরা দিলে ৩০০ টাকা পাই। আর গাড়ি অর্ধেক রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হলে ওইদিন আমাদের হাজিরা দেওয়া হয় না। এছাড়া দুই বেলা ট্রিপ দিয়া রাজস্ব না উঠলে পকেট থেকে রাজস্ব পরিশোধ করা লাগে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি কন্ডাক্টর হইলেও হেলপার আর সুইপারের কাজ করা লাগে। ঘুম থেকে উঠি ভোর পাঁচটায়, ডিপোতে যাই সাতটায়। এরপর কিছু কাজ করে গাড়ি বাইর করি। সকালের ট্রিপ সাইরা বাসায় যাই ১১টায়। আবার বিকাল ৪টায় বিকালের ট্রিপে যাই। সেখান থাইকা রাইত ১০টা বাজে বাসায় যেতে। এর বিনিময়ে পাই ৩০০ টাকা। যাত্রী না পাইলে এইডাও কপালে জোটে না।’

সূত্রে জানা গেছে, এসব ‘মহিলা বাস সার্ভিস’র জন্য সরকারিভাবে ১২ জন মহিলা কন্ডাক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। তারা সরকারি হিসেবে ড্রাইভারদের মতো বেতন, ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়ে থাকলেও গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন না। রাস্তায় বের হওয়া তো দূরের কথা, তারা অফিসে এসে অফিসারের আচরণ করেন।

উল্লেখ্য, ‘মহিলা বাস সার্ভিস’ নাম হলেও কোনো বাসেই মহিলা চালক রাখা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর-১২ নাম্বার ডিপোর সাবেক এক মহিলা কন্ডাক্টর এখন গাজীপুরে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণ শেষেই তাকে গাড়ি দেওয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর