কোন পথে হাঁটবেন বিমানের এমডি মোকাব্বির?

ঢাকা, জাতীয়

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 07:37:25

গত রোববার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও হিসেবে যোগ দিয়েছেন মোকাব্বির হোসেন। তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব।

বর্তমান দায়িত্ব নেওয়ার আগে মোকাব্বির হোসেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

২০০৭ সালে বিমান করপোরেশন থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে (পিএলসি) রূপান্তরের আগে দেশের আমলারাই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সাধারণত সরকারের একজন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাই এ পদে নিয়োগ পেতেন- এটাই ছিল দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। ২০০৭ সালে সর্বশেষ এমডি হিসেবে যুগ্ম সচিব ড. এমএ মোমেন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়েছিলেন। কিন্তু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ালাইন্স বিমানের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই এয়ারলাইন্স প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিমান একটি লোকসানি সংস্থার খাতায় নাম লিখিয়েছে। বিমানের লোকসান নিয়ে দেশের গণমাধ্যমে অজস্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একপর্যায়ে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানের চক্র থেকে বের করতে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। যদিও এর শতভাগ মালিকানা সরকারের হাতেই রাখা হয়। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। আর এজন্যই এ খাতে কাজ করা অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী যাত্রাও শুরু করে বিমান। ২০১৩ সালে এজন্য ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও ইতিহাদ এয়ারওয়েজসহ স্বনামধন্য বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে কাজ করা ২০ বছরের বেশি অভিজ্ঞ কেভিন স্টিলকে নিয়োগ দেওয়া হয় বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে। তিনিই ছিলেন প্রথম বিদেশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নিয়োগ পেয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন সময় মতো ফ্লাইট ছাড়ার ওপর এবং অন টাইম ফ্লাইট ডিপার্চার প্রায় ৭০ শতাংশে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিমানের মতো প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক চেহারা মাত্র দুই বছরের মধ্যে বদলে ফেলা সম্ভব নয়। তাছাড়া তিনি যেসব জায়গায় হাত দিতে চেয়েছিলেন, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থান্বেষী মহল। তাদের থেকে আসে নানা বাধা। আর তাই দুই বছরের মেয়াদে নিয়োগ হলেও মাত্র এক বছরের মধ্যেই তাকে বিদায় নিতে হয়। এরপর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও এয়ার এরাবিয়া এয়ারলাইন্সের মতো খ্যাতনামা এয়ারলাইন্সে কাজ করা কাইল হেউডকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনিও এক বছরের মধ্যে বিমান থেকে বিদায় নেন। এরপর আবার দেশীয় লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সর্বশেষ সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোসাদ্দেক আহমেদের বিরুদ্ধে পাইলট নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিমানের পরিচালনা পর্ষদ তাকে সরিয়ে দেয়।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এখন মূলধন সংকটে রয়েছে। শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির মূলধনের চেয়ে ঋণ কয়েক গুণ বেশি হওয়ায় তার ঋণ নেওয়ার যোগ্যতাও হারিয়েছে। মূলত মূলধনের চেয়ে ঋণ বেশি হওয়ার কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এক হিসেব থেকে দেখা গেছে, বিগত ১০ বছরে বিমান ছয় বছরই লোকসান দিয়েছে। এ সময়কালে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। বারবার লোকসানের ফলে প্রতিষ্ঠানটি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। টাকার অঙ্কে তা এক হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। আর তিন বছরে লাভের পরিমাণ ৫৫৯ কোটি টাকা। লাভ থেকে লোকসান বিয়োগ করলে এ সময়কালে লোকসানের পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা।

লোকসানের বাইরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) বিমানের দেনার পরিমাণ ২৫০০ কোটি টাকার ওপরে। লোকসান ও দেনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি মূলধন সংকটে আবর্তিত। অবশ্য সর্বশেষ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে পাওনা হিসেবে ৫৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

২০১৭-১৮ অর্থ বছরেই বিমান লোকসান দিয়েছে ২০১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ওই অর্থ বছরে বিমানের আয় ছিল ৪ হাজার ৯৩১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আর ব্যয় ছিল ৫ হাজার ১৩৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ২৩৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ২০১৪-১৫ সালে ২৭৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা লাভ করে বিমান।

২০১০-১১ অর্থ বছরে ২২৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ৯৪ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ১৯১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে বিমান।

সামনে লোকসানের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসাই এখন বিমানের বড় চ্যালেঞ্জ। বিমানের বর্তমান এমডি মোকাব্বির হোসেন কি লোকসানের চক্র থেকে বের হতে পারবেন? আমলারা ব্যর্থ হওয়াতেই ২০০৭ সালে বিমানকে পিএলসি করা হয় এবং বাণিজ্যক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরই এ পদে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। ৩৫ বছর ধরে আমলারা যে প্রতিষ্ঠানটিকে চালাতে পারেননি, এটি নতুন করে বলার কিছু নেই। তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন বলেই মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে এটিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয়।

এখন প্রশ্ন, আবার কি বিমান সেই পুরনো পথেই হাঁটবে? প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে যোগদানের চার দিনের মাথায় গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের সভা কক্ষে তিনি প্রথমবারের মতো সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে তাকে দেখে টিপিক্যাল একজন আমলাই মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিমানের চতুর্থ বোয়িং উড়োজাহাজ উদ্বোধনের সময় বলেছিলেন, আরো দু’টি বোয়িং কেনার সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কথার বাইরে একটি কথাও বলেননি। বিমানের বর্তমান ডিজিএম পিআর তাহেরা খন্দকারের বিরুদ্ধে সহযোগিতামূলক আচরণ না করার যে অভিযোগ, সে বিষয়ে সাংবাদিকরা একাধিক প্রশ্ন করলেও এমডি বারবার পেছনের তিক্ততা ফেলে সামনের দিকে তাকানোর কথা বলেন।

সত্যি বলতে একজন আমলা হিসেবে একজন যতটা দক্ষতার পরিচয়ই দেন না কেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালাতে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ লোকের কোনো বিকল্প নেই। যদি আমলা দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে তা লাভজনক সংস্থায় পরিণত করা যেত, তাহলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক, বাংলাদেশ টেলিকমিউনেকশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), টেলিফোন শিল্প সংস্থাসহ (টেশিস) আরো যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তা যুগ যুগ ধরে লোকসানি না হয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো। এখন দেখার বিষয় বর্তমান এমডি একজন আমলা হয়ে তার পুরনো সহকর্মীদের দেখানো পথে হাঁটবেন নাকি টিপিক্যাল আমলাতন্ত্রের খোলস থেকে বের হয়ে বিমানকে তিনি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পথে হাঁটতে পারবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর