‘আগের সেই দিন আর নেই সৌদি আরবে’

, জাতীয়

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 20:49:57

 

সৌদি আরব (মক্কা)থেকে: বেকারত্ব আর আর্থিক মন্দায় বিপাকে পড়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের প্রবাসী ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। সেই সঙ্গে নতুন নতুন ফরমান জারি আর আর্থিক সংস্কারের কারণে যত দিন যাচ্ছে ততই কঠিন থেকে কঠোরতর পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে সৌদি প্রবাসীদের।

সৌদি আরবে এসে চাকরি না পেয়ে যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে মুদি, দর্জি, সেলুন, বোরকার দোকান, মাছ, সবজি,মোবাইল ফোনের দোকান ও হোটেল-রেস্তোঁরা খুলেছিলেন ভালো নেই তারাও। একদিকে যেমন ব্যবসা কমেছে অন্যদিকে বেড়েছে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়। সব মিলিয়ে বেশ বিপাকেই রয়েছেন এসব ব্যবসায়ীরা।

সৌদি আরবে নিজের দোকান বা হোটেল দৃশ্যমান থাকলেও আসলে কোন মালিক নয় তারা। বিনিয়োগ থেকে ব্যবসা পরিচালনা, ঝুঁকি মোকাবেলা, কঠোর শ্রমের বিনিময়ে টিকে থাকার অদম্য চেষ্টাসহ সব কিছুই করতে হয় প্রবাসীদের। তবে কাগজে কলমে এর মালিক সৌদি নাগরিক। যার লাইসেন্সে মূলত চলে ব্যবসা।

এই লাইসেন্সধারীদের ‘কফিল’ বা নিয়োগ কর্তা বলা হয়। ফলে তাদের হাতেই এক রকম জিম্মি জীবন ব্যবসায়ীদের। সৌদিতে থাকতে হলে কফিলকে মাসোয়ারা হিসেবে বছর শেষে দিতে হচ্ছে আয়ের একটি বড় অংশ। তার সঙ্গে রয়েছে ফি বছর দোকান ভাড়া ও ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির  সঙ্গে  তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রবাসী উদ্যোক্তরা।

সৌদিতে ব্যবসা করে টিকতে না পেরে দীর্ঘদিনে গড়ে তোলা ব্যবসা ছেড়ে দেশে পাড়ি দেওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তবে দেশে ফিরছেন রিক্ত আর নি:স্ব হয়ে। যারা রয়েছেন তারাও দেশে ফেরার  প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ব্যবসার এমন মন্দা পরিস্থিতিতে মক্কা নগরীর সেবা আমির জবলে সউদান নামে পাহাড়ের বুকে এখন এই প্রবাসীদের দীর্ঘশ্বাস।

সৌদি আরবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমেদ (৩৮)। ১০ বছর ধরে সৌদিতে রয়েছে চট্রগ্রামের সাতকানিয়ার পশ্চিম ঘাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের মোস্তাক। এখানে তার  একটি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর রয়েছে। ব্যবসা জমজমাট হলে দেশ থেকে নিয়ে আসেন ছোট ভাই জসিম উদ্দিনসহ এক ভাগ্নেকে। গত ছয় মাস ধরে ব্যবসায়ীক মন্দায় কঠিন সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে মোস্তাককে

এমনকি ব্যবসার পরিসর বাড়াতে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখান থেকে সরে এসে উল্টো ব্যবসা পরিচালনা করাটাই তার কঠিন হয়ে পড়েছে।

মোস্তাক বার্তা২৪.কমকে বলেন, আরে ভাই, সৌদি আরব আর আগের মতো নেই। ক্রেতা কমেছে। ব্যবসায় ক্ষতি হলেও দোকান ভাড়া,বৈদ্যুতিক বিলসহ যাবতীয় ব্যয় বেড়ে যায়। তাই এসব মিটিয়ে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

প্রবাসী ব্যবসায়িরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকে কঠিন মন্দার পথে হাঁটছেন প্রবাসী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা। এরমধ্যেও কেউ জমানো অর্থ ভাঙিয়ে খাচ্ছেন। কেউ বা সুদিন আসবে - এমন আশায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন।

মক্কার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা আর পারছি না। আগামী হজ্বের পর পরিস্থিতি দেখবো। টিকতে না পারলে চলেই যেতে হবে। ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো না। পর্যাপ্ত কাজ নেই। আবার কাজ থাকলেও যথাযথ বেতন নেই। অশান্ত শ্রমবাজার। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতকে সামনে রেখে বর্তমান সময়কে পাড়ি দিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন অনেকে।

তবে এমন বৈরী পরিবেশেও দিবাস্বপ্ন নিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে দলে দলে মানুষ ঢুকছে সৌদিতে। ফ্রি ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়ে গভীর সংকটের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন এই অভিবাসীরা। এমনিতেই কর্ম সংকট। তার ওপর দেশ থেকে আসা বাড়তি শ্রমিকের এই চাপ। সব মিলিয়ে ভারসাম্যহীন এখানকার শ্রম বাজার।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। তবে দেশে থাকা মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের কারসাজিতে অভিবাসী ব্যয়ের ১৬ আনাই মিছে হয়ে যাচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের। বছর শেষে হিসেবে কষে দেখা যাচ্ছে অভিবাসন ব্যয় বাদ দিয়ে শ্রমের কোন মূল্য নেই।

অন্যদিকে স্থায়ী কাজের অভাব ও নারী শ্রমিকদের নিপীড়িত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের শুরুতে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি কমতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধি।

অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ভিসা-বাণিজ্যের কারণে অভিবাসন ব্যয় কমছে না। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

আগে দুই হাজার রিয়েলে আকামা (রেসিডেন্স পারমিট) পাওয়া গেলেও ক্ষেত্রে বিশেষে তা উঠেছে ১০/১২ হাজার রিয়ালে। চাহিদা মতো অর্থ দিতে না পারলে কফিল আকামা। নবায়নে গড়িমসি করে। আবার সময় মতো নবায়ন না করলে প্রবাসীদের ৫০০ রিয়াল জরিমানা গুণতে হয়।

ফলে ভাগ্য বদলের হাজারো স্বপ্ন নিয়ে এখানে পাড়ি দিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন অভিবাসী শ্রমিকরা।

মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরবই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। দেশ থেকে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের চাহিদা মেটাতেই উদ্যোক্তা হয়েছিলেন মোস্তাকের মতো অনেকেই। তবে অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ভিসা-বাণিজ্যের কারণে অভিবাসন ব্যয় দিন দিন বাড়ছে।

 

যার ফলে অবৈধভাবে সৌদিতে বসবাস ও শ্রম আইন লংঘন করা শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। ধর পাকড়ে আটক করা হয়েছে বহু শ্রমিক। এদের মধ্যে ১৫ হাজার ৭০২ জনকে আকামা ভঙ্গ, ৪ হাজার ৩৫৩ জনকে শ্রম আইন লঙ্ঘন করা এবং ৩ হাজার ৮৮৩ জনকে সীমান্ত নিরাপত্তা আইন লংঘনের অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আবার নতুন শ্রমিক এসেও না পাচ্ছেন কাজ। না পারছেন বৈধভাবে বসবাস করতে।

সব মিলিয়ে চাপটা এসে পড়ছে এই শ্রেণিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ব্যবসায়িদের উপর। সব মিলিয়ে শ্রম বাজার ঘিরে চলছে নিরব এক অস্তিরতা। এতে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার ভাঁজ পড়েছে মোস্তাকদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কপালে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর