রোহিঙ্গারা বিচার পাবে কি?

, জাতীয়

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-22 14:49:50

রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি)মিয়ানমারের বিচার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের মতামত জানতে চেয়েছে আইসিসি। গণমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ আইসিসিতে মিয়ানমারের অপরাধ তদন্ত ও বিচারের জন্য নীতিগতভাবে সম্মত।

আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচারের প্রশ্নে সম্মতি প্রদান বাংলাদেশের জন্য একটি সাহসী উদ্যোগ। বাংলাদেশ যাতে আইসিসির দ্বারস্ত না হয় সে জন্য মিয়ানমার ছলচাতুরি কম করেনি। তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে আর ফিরিয়ে নেবে না, দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হবে-এ জাতীয় জুজুর ভয় ও অজুহাত দেখিয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এক জিনিস আর তাদের ওপর নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের বিচার হওয়া আরেক জিনিস। তবে, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচার চাওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত।

মিয়ানমারের বিচার করার জন্য আইসিসির অঞ্চলগত বা ভূখণ্ডগত এখতিয়ার (Terrritorial Jurisdiction) আছে কিনা সেটি এখানে একটি বড় প্রশ্ন। কারণ, মিয়ানমার আইসিসি সনদে সাক্ষর করেনি। তাই তাদের দাবী, আইসিসির মিয়ানমারের বিচার করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু সনদে সাক্ষর করাই এখতিয়ারের একমাত্র উপায় না।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তবে আইসিসিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিচারের বিষয়টি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর একটি বাড়তি চাপ প্রয়োগ করবে।

গত আগস্ট থেকে মিয়ানমার থেকে সাড়ে সাত লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। এর সাথে আগে চলে আসা রোহিঙ্গারাতো আছেই্। সব মিলিয়ে ১০ লক্ষের ওপর রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এখন আশ্রিত। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমার তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে বাংলাদেশ চলে আসতে বাধ্য করেনি। এটি তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনারই একটি অংশ। কিন্তু বাংলাদেশইবা ‌এই বিপুল সংখ্যক মিয়ানমার নাগরিকদের দায়িত্ব কেন নেবে? সব মিলিয়ে বিষয়টি আর দ্বিপাক্ষিক পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিশ্বের অপরাপর পরাশক্তিগুলোও এখানে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ তথা নিরাপত্তা পরিষদেও তারা রোহিঙ্গা প্রশ্নে ঐকমত্য হতে পারেনি।

মিয়ানমার অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি সই করেছে। এটি মিয়ানমারের এক নতুন কৌশল। তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিয়ে বিশ্ববাসীকে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য তথাকথিত উদ্যোগী ভূমিকা জাহির করতে চায়। কিন্তু বাস্তবে প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উ থাং টুন বলেছেন যে তারা সব রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু বাস্তবে তারা কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছেনা।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সাথে যা করেছে যেকোনো হিসেবেই তা গণহত্যা। এই গণহত্যার বিচার চাওয়া একটি মানবিক ও মানবাধিকারের দাবি।

কিছুদিন আগে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তারা বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করে গেছেন। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেনা। কারণ চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে তাদের ‘ভেটো অস্ত্র’ প্রয়োগ করছে। কিন্তু বিশ্ববাসী মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেই যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও কানাডা তাদের সুর কিছুটা নরম করেছে। ভারতও তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তারা সবাই এখন ‘রোহিঙ্গা’ ইস্যুর জন্য মিয়ানমারকেই দায়ী করছে। ফলে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান এখন আগের চেয়ে সুদৃঢ়। সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি কারে পিয়েরস বলেছেন, মিয়ানমার যদি তার সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড তদন্ত করতে ব্যর্থ হয় তবে তারা আইসিসিকে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য পাঠাতে বাধ্য হবে। তার মানে, নিরাপত্তা পরিষদও জানে আইসিসির অপরাধ তদন্ত করতে কোনো বাধা নেই। শুধু তাদের সুপারিশই যথেষ্ট।

বিশ্ববাসী জানে, মিয়ানমার এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকেই এর সমাধান করতে হবে। ‘শরণার্থীদের নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার একমাত্র গ্রহণযোগ্য আইনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সব রকম প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে মিয়ানমারের বিচার হওয়াও জরুরি। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র দেওয়ানি কার্যক্রম বা প্রত্যাবাসনই যথেষ্ট নয়, ফৌজদারি পদক্ষেপও জরুরি। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে। এসবই আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ। আন্তর্জাতিক আদালত (International Court of Justice-'ICJ') ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (International Criminal Court-'ICC') এসব অপরাধের বিচার হতে পারে। শুধু এখতিয়ারগত বিষয়টিই এখানে বিবেচ্য।

আইসিসি সনদ অনুযায়ী তারা গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, ও আগ্রাসনের বিচার করতে পারে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইসিসি সনদে বর্ণিত বেশ কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত করা যায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে, তাদেরকে নির্বাসন বা জোড়পূর্বক স্থানান্তর করেছে, নানাভাবে নির্যাতন করেছে, ধর্ষণ, গুম এমনকি জাতিগত হিংসা বা বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এসবই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। প্রত্যাবাসেনর পাশাপাশি এসব অপরাধের বিচার হওয়া সভ্যতার দাবী। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উচিৎ মিয়ানমারের বিচারের প্র্রশ্নে সরব হওয়া। নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশের পর বাংলাদেশের সুস্পষ্ট সম্মতির বিষয়টি আইসিসি কর্তৃক মিয়ানমারের বিচারের পথকে আরো সুগম করবে। বিচারের প্রশ্নে কোনো দ্বিমুখী নীতি এক্ষেতে কোনো সুফল বয়ে আনবেনা। রোহিঙ্গারা সবকিছু হারিয়েছ। এবার অন্তত বিচার পাওয়ার এ সর্বশেষ অধিকারটি বিশ্ববাসী তাদের জন্য নিশ্চিত করুক।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর