থাইল্যান্ড ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, থাইল্যান্ড থেকে ফিরে | 2023-09-01 22:18:23

কোনো দেশে গেলে সেই দেশের লোকাল বাস কিংবা সিটি পরিবহনে ভ্রমণ করা আমার এক রকম শখের মতো হয়ে গেছে। এর পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে, একটি হচ্ছে সেই দেশের জীবনমান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া, পাশাপাশি খরচটাও সাশ্রয় করা।

সম্প্রতি ব্যাংকক শহরে লোকাল বাসে উঠতে গিয়ে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছে। গন্তব্য ছিল ব্যাঙ্কাপি, এটুকু সম্বল। বাসের নম্বর রুট সবই অজানা, বাস স্টপেজটিও ফাঁকা। কয়েক গজ দূরে জুতার দোকানে ঢুকে দেখি, দুই কিশোরী। একটির বয়স পনেরর কাছাকাছি হবে, অপরটির নয়-দশের মতো।

বড় মেয়েটি এক ক্রেতাকে জুতা দেখাচ্ছিল। তার কাছে ব্যাঙ্কাপির বাসের তালাশ করতেই চটপট জবাব দিল, আই ডোন্ট নো। জাস্ট ওয়েট এ মোমেন্ট। টক উইথ মাই মাদার। ছোটো মেয়েটিকে ক্রেতা সামলানোর নির্দেশ দিয়ে দোকানের পেছনের কোনের প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে গেল কিশোরীটি। মুহূর্তেই আবার মেয়েটি নেমে এল। পেছন পেছন চোখ কচলাতে কচলাতে নেমে এলেন কিশোরীর মা। ওই নারী ইংরেজি বলতে পারেন না। কিশোরী দোভাষির ভূমিকা নিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা শুনে তার মাকে থাই ভাষায় বলল। ওর মা আবার তাকে ব্রিফ করলে, মেয়েটি আমাদের সঙ্গে করে দোকানের বাইরে এসে বাস স্টপ দেখিয়ে দিল। আর বলল, বাস নম্বর সিক্স জিরো।

কয়েক মিনিট পরেই দেখা মিলল ৬০ নম্বর বাসের। শুধু নম্বটি ইংরেজিতে। আর সবই থাই ভাষায়। বাসে উঠে নারী সুপারভাইজারকে বলতেই নির্ধারিত ভাড়া কেটে নিলেন। তাকে জানিয়ে দিলাম আমরা ব্যাঙ্কাপি চিনি না। ব্যাঙ্কাপি চলে এলে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধসহ।

কেউ মনে করতে পারেন, হয়তো মেয়েটি ভালো ছিল বলে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু না পরের দিন আবার বাস ধরব, এবার গন্তব্য সুকুম্ভিত-৩ থেকে ব্যাংকক হাসপাতাল। ফুটপাতে এক নারী দোকানি তখন সবেমাত্র দোকান খুলে পসরা সাজাচ্ছিলেন। তাকে রাস্তা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তিনি ইংরেজি জানেন না, আকারে ইঙ্গিতে হাসপাতালের রাস্তা খোঁজার বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রায় ১শ’ গজ সঙ্গে করে নিয়ে সামনে একটি বড় সাইনবোর্ডে ব্যাংকক লেখা দেখিয়ে দিলেন। আমরা যখন না সূচক জবাব দিলাম। তখন আরেকটি মেয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। ওই মেয়েটি বেশ ভালোই ইংরেজি জানেন বলে মনে হলো। ঝটপট জনিয়ে দিলেন বাসের নম্বর এবং কোন স্টপেজে নামতে হবে।

Thai
এভাবে সাজানো গোছানো থ্যাইল্যান্ডের সাগরপাড়, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

 

আরেকটি ঘটনা চাতুচাক মার্কেটের। সহকর্মী মুবিনুল ভাই একটি পণ্য কিনতে চান। মোবাইল ফোনে ছবি দেখালেন এক নারী দোকানিকে। এখানে বলে নেওয়া অবশ্যক থাইল্যান্ডের বেশিরভাগ দোকানি নারী। ওই নারী নিজের দোকান ছেড়ে পরের গলিতে এসে আমাদের দোকান দেখিয়ে দিলেন। এ দোকানি ইংরেজি না জানায় এখানে দোভাষির কাজ সারলেন নিজের দোকান ফেলে।

আমার দেশের কোনো দোকানির কাছে এমন আচরণ আশা করা যায়? অনেকে তো কথাই বলতে চান না। খুব বেশি হলে বলবেন, সামনে দেখেন, পরের গলিতে থাকতে পারে।

আরেকটি ঘটনা, এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি আগেই বুকিং দেওয়া ছিল। প্রায় ৪০ মিনিট আগেই হাজির। যথা সময়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে তাকে অনুরোধ করলাম, আমরা আগে নাস্তাটা সেরে নিতে চাই। এতে যাত্রার শুরুতে নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট গড়িয়ে যেতে পারে। ড্রাইভার মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। লাগেজ গাড়িতে ওঠানো, নামানো, এয়ারপোর্ট পৌঁছে ট্রলি এনে লাগেজ তুলে দিতে তার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। আবার ভাড়াও কিন্তু নির্ধারিত ৫শ’ বাথেই নিলেন। আমরা বাঙালিরা হলে অপেক্ষমাণ সময়ের বাড়তি ভাড়া আদায়ে সচেষ্ট থাকতাম।

এ রকম আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা শ্রদ্ধায় যেন মাথা নুয়ে পড়ার মতো। আর আমরা কি করছি? ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং খুঁজে হয়রান হচ্ছিলাম। বনানী এগারো নম্বরে ডাচ্-বাংলার ফাস্ট ট্যাকে গেলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বললেন, আমাদের এখানে জমা দিতে পারবেন, টাকা পাবেন কালকে। আপনি যদি এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে জমা দেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবেন।

তার কাছে জানতে চাইলাম, কোথায় এজেন্ট ব্যাংকিং পাওয়া যাবে? তিনি বললেন, আমি এ এলাকায় নতুন এসেছি, জানি না। এরপর খুঁজতে খুঁজতে গুলশান ১ নম্বর থেকে হাতিরঝিলে যাওয়ার পথে আরেকটি ফাস্ট ট্র্যাকে গেলে তিনিও জানালেন, এখানে জমা দিলে পর দিন পাবেন। তার কাছে জানতে চাইলাম, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ঠিকানা। বললেন, গুগলে সার্চ দেন, পেয়ে যাবেন।

পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনার সামনে তো কম্পিউটার খোলা, একটু সার্চ দিয়ে বলা যায় কি না? উত্তর এলো, আমার এখানে শো করবে না। এ হলো বাংলাদেশ আর ব্যাংককের পার্থক্য।

thai
ব্যাংকক শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নদী, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

 

ট্যুর অপরেটর এক্সিলেন্স এশিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবি সিদ্দিক টিটো এক েদিন বলেছিলেন, আমাদের পর্যটন স্পটের মানুষজন ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি নন। আমাদের আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে। এবার সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, মানুষ কেন বারবার থাইল্যান্ডে যেতে চায়।

আমার বেশ কয়েকজন কলিগ রয়েছেন। যাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারতসহ অনেক দেশ সফর করেছি। তাদের যদি বলি, চলেন মালয়েশিয়া যাই। তারা বলেন, আগ্রহ নেই। তবে সুযোগ পেলে আবার থাইল্যান্ড যেতে চাই।

থাইল্যান্ডের লোকজন বেশিরভাগই ভালো, খুবই আন্তরিক। তবে কিছু ট্যাক্সিচালক একটু বাড়তি দাম হাঁকিয়ে থাকেন। যে কারণে এ ক্ষেত্রে একটু সচেতনতা জরুরি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর