‘সৌদি আরবে আসার আগে বুঝেশুনে আসুন’

, জাতীয়

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-25 23:12:40

সৌদি আরব (মক্কা) থেকে: ভাগ্য অন্বেষণে তিন যুগ আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বেতন ছিলো বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ৬ হাজার টাকা। বেতন কম হলেও টাকার মান আর জীবনযাত্রার ব্যয়ে ছিলো স্বস্তি। পরে চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ব্যবসা। মেধা আর পরিশ্রমে আজ তিনি পবিত্র মক্কা নগরীর মসজিদ আল হারাম সংলগ্ন তারকাখচিত ব্যস্ততম তিনটি হোটেলের ব্যবসায়িক অংশীদার। রয়েছে আরও অনেক ব্যবসা।

তিনি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার ভাওরকোট ভূঁইয়াবাড়ি গ্রামের নূর মোহাম্মাদ ভূঁইয়া (৫৮)।

এতকিছুর পরেও মনে সুখ নেই তার। দুচিন্তায় কপালে ভাঁজ। পড়ে যাচ্ছে মাথার চুল। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে দিন দিন গুটিয়ে আনছেন নিজের ব্যবসা- বাণিজ্য। স্বেচ্ছায় তো নয়ই, বরং বাধ্য হচ্ছেন। এক সময়ের রমরমা আর চালু ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তিনি। তার মতো প্রভাবশালী ব্যবসায়ির এত হতাশার কারণ কি?

অকপট জবাব, ‘আমাকে অংশীদার বা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, দয়া করে কোনোটাই বলবেন না। কারণ কাগজে কলমে আমি নিজেও এখানে একজন কর্মি মাত্র। এটাই এখানকার বাস্তবতা। যত যাই করেন, সব ব্যবসার মালিকানা এখানকার সৌদি নাগরিকদের। তাদের কর্মি, এই পরিচয়েই আমরা এখানে আছি। তবে কতদিন টিকে থাকতে পারবো- তা বলতে পারছি না। কারণ পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে করে অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে এখানকার ব্যবসার পরিবেশ।’

নূর মোহাম্মাদ ভূইয়া বলেন, ‘২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের শ্রমবাজারের দরজা বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব। রিয়াদে ক্যাবল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দূর্যোগ নেমে আসে শ্রমিকদের ওপর। সব কিছু বৈধ থাকার পর দলে দলে বাংলাদেশিদের ধরে জোর করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার মতো ব্যক্তিও বাদ পড়েনি। আমাকেও তালিকাভুক্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। কারণ আমি এখানে ভালো ছিলাম। ভালো ব্যবসা করছিলাম। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।’

নূর মোহাম্মাদ ভূইয়া বার্তা২৪.কমকে আরও বলেন, ‘গত দেড় বছর ধরে এখানে কোনো কাজ নেই। সৌদি সরকারের শ্রম বাজার সংস্কার নীতির মুখে বিপাকে পড়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। এখনকার নতুন নিয়মে পরিবার নিয়ে কাউকে থাকলে হলে সন্তান জন্ম নেওয়া মাত্রই মাসে সরকারকে দিতে হবে ৩শ' রিয়াল। যে কারণে অনেকেই পরিবার দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। জেদ্দায় পরিচালিত বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এক ধাক্কায় নেমে গেছে অর্ধেকে।

আরেক আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক নিয়োগে নতুন নীতিমালা। এখন থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৪ জন অভিবাসী শ্রমিক থাকলে তার বিপরীতে একজন সৌদি নাগরিক নিতে হবে। যার হতে বেতন হতে হবে ন্যূনতম সাড়ে তিন হাজার রিয়াল। এ ছাড়াও ফি বছর অভিবাসী শ্রমিকদের আকামা নবায়ন করতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা।

এমনিতেই কাজ নেই। তার ওপর এত কড়াকড়ির মুখে বিদেশি শ্রমিকদের বাদ দিতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই চাপটা পড়েছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর।’

দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার পর ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জন্যে শ্রমের বাজার খুলে দেবার পর দেড় লাখ নারী শ্রমিকসহ এ দেশে ঢুকেছে সাত লাখের মতো শ্রমিক। যাদের অর্ধিকাংশের হাতে এ মুহুর্তে তেমন কাজ নেই।

একজন শ্রমিক গড়ে ৬ লাখ টাকা খরচ করে এসে অবশিষ্ট জীবনে অভিবাসন ব্যয় তো তুলতেই পারবে না, বরং নিজের জীবনটাকেই সে নষ্ট করছে এখানে। মোটা অংকের টাকা খরচ করেও এখান থেকে দেশে টাকা পাঠাতে পারছে না। তাহলে হিসাবটা কি দাঁড়ালো? সাত লাখ শ্রমিকের মাধ্যমে দেশ থেকে ৩০/৪০ হাজার কোটি টাকা বের হলো ঠিকই- কিন্তু দেশে ঢুকলো না তার সিকিভাগ।

সুতরাং আর্থিক ও শ্রম। দু’দিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। সরকারের মন্ত্রণালয় শ্রমিক পাঠিয়ে বাহবা নিতে পারে, কিন্তু শেষ বিচারে অভিবাসী প্রত্যাশী শ্রমিক গরীব থেকে আরও নিঃস্ব হচ্ছে। এখনই উচিৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা।

আমার আহবান, প্লিজ! সৌদি আরবে আসার আগে বুঝেশুনে আসুন। দয়া করে কারো প্রলোভন বা মিথ্যা আশ্বাসে আসবেন না। এলেই ফাঁদে পড়লে সেই ক্ষতি থেকে জীবনে আর বের হতে পারবেন না। আমি দেশে গেলে বিভিন্ন ফোরাম এমনকি টেলিভিশন টক শো’তে এটাই বলার চেষ্টা করি। মানুষকে সচেতন করতে হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে।

আমার কথাই যদি বলি, গত এক বছরে কেবল আমি নিজে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ১০ কোটি টাকার বেশি। আর পারছি না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তিনটির মধ্যে দু’টি হোটেল ছেড়ে দেবো।

পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে সৌদি আরবে অভিবাসী ২০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে অর্ধেকেই টিকতে না পেরে চলতি বছরই দেশে ফিরতে হবে। কোনো উপায় নেই। এই বিপর্যয় কিভাবে সামাল দেওয়া হবে, আমাদের দেশের সামর্থ্য কতটুকু তা ভাবনার সময় এসেছে- যোগ করেন নূর মোহাম্মাদ ভূইয়া।

এ সম্পর্কিত আরও খবর