খাওন পাই না আবার ঈদে কোরমা পোলাও!

, জাতীয়

লক্ষ্মীপুর করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-22 16:50:46

লক্ষ্মীপুর: ‘নদীতে মাছ ধইরা যে টাহা পাই, তা দিয়া সংসারের খাওন (খাবার) জুটে না আবার ঈদে নুতন জামা- কাহড় (কাপড়), কোরমা, পোলাও? এগুলা দিয়া কী অইবো, আমাগো ঈদ কাটে পেডের যোগান মাছ ধরতে ধরতে। আমাগো আনন্দ সংসারের খাওন জুটানো আর মহাজনের দেনা পরিশোধে।’

নৌকায় জাল থেকে মাছ বাছতে বাছতে কথাগুলো বলছিলেন লক্ষ্মীপুর চর রমনী মোহন ইউনিয়নের  মজুচৌধুরীর হাট এলাকার মানতা (ভাসমান জেলে) পারভিন আক্তার। তিনি জন্মের পর থেকেই বাবা ও বিয়ের পর স্বামীর নৌকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মা তিনি। 

তিনি আরও বলেন, ‘সংসারে অনেক অভাব। নদীতে এহন আর আগের মতো মাছ ধরা হড়ে না। যেদিন মাছ বেশি হাই, হেদিন একটু বালা খাই। ঈদের দিন মাংস দিয়ে দুই বেলা পেট ভইরা ভাত খাইতে হারুম নি, পোলাপানেরে নতুন জামা কাহড়ই লই দিতাম হারি না। নছিবো যা আছে তাই অইবো’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পারভিনের মতোই চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি পর্যন্ত মেঘনা নদীর প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছেন অন্তত সাড়ে ৩ হাজার মানতা (ভাসমান জেলে)। নদী থেকে নদীতে বয়ে চলে তাদের নৌকা। মানতাদের প্রধান পেশা হচ্ছে মাছ ধরা। তারা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে বছরের পর বছর লড়াই করে পানিতে ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করছে।

চারিদিকে ঈদ আনন্দ থাকলেও নেই মানতাদের। নদীতে মাছ ধরে যে টাকা পান সে টাকা মহাজনদের দেনা আর ডাল ভাত যোগাতেই শেষ হয়ে যায়। তাই পারছেন না ছেলেমেয়েদের ঈদে নতুন জামা কাপড় দিতে। পারছেন না সেমাই, ফিরনি, নুডলস, বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন নামীদামি খাবার খেতে। তাদের ঈদ কাটে নদীতে মাছ ধরার মাধ্যমে।   

সরেজমিনে সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলেমেয়ে আর পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকায় বসে আছে মানতারা। কেউ জাল বুনছে, কেউ জাল থেকে মাছ নিচ্ছে, আবার কেউ রান্না করছে। তাদের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। মানতাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নদীর পাড়ে খেলা করছে, আবার কেউ বাবা মাকে সাহায্য করছে। তাদের শরীরে পুরাতন ছেঁড়া কাপড়।  

এদেরই একজন মো. দুলাল হোসেন। আলাপকালে  বলেন, ‘আমাগো বাড়িঘর, জায়গা-জমি নাই, নৌকায় থাহি। সরকারের কাছ থেকে তেমন একটা সহযোগিতা পাই না। নদীতে মাছ ধরলে খাবার জোটে, অন্যথায় না খেয়ে কাটে। আমাগো আবার কিসের ঈদ আনন্দ?’

শমজান বিবি বলেন, ‘সবাই নতুন জামা কাপড় পিনবে, পোলাপানরে লইয়া আনন্দ কইরবো। আর আমরা পুরান জামা হরি নদীতে মাছ ধরেই আনন্দ করমু। ডাল আর ভাত খেয়েই কাটবে ঈদের দিন।’

টাকা নাই বলে নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারেন না এখানকার বাসিন্দারা। তাই পুরাতন জামা পরেই কাটে তাদের ঈদ। আর পারেন না  ধনী ব্যক্তিদের মতো নামীদামি খাবার খেতে। ঈদের আনন্দ বলতে এখানে আসা লোকদের নদীতে নৌকায় করে ঘুরানো, কিছু টাকা আয় করা। এমনটি জানালো মনতা পল্লীর ছোট্ট শিশু সাকিব হোসেন। 

মনতা পল্লীর হাসিনা আক্তার বলেন, ‘নদীতে মাছ ধরে যে টাকা আয় করি, বিভিন্ন খরচের পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে মাংস কেন হাড়ও পাওয়া যাবে না। তাই আফসোস করি না, ঈদের দিনকেও অন্য দিনের মতোই মনে করি। কারণ আল্লাহ আমাগো কপালে ঈদ আনন্দ দেয় নাই।’

নদীর পাড়ে খেলা করছে ছোট শিশু আছমা, ইতি, বেলি ও শাহানাজ আক্তার। আলাপকালে তারা জানায়, কেউ যদি এসে জামা কাপড় বা ভালো খাবার দিয়ে যায় তা হলে অনেক আনন্দ পায় তারা। 

এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর চর রমনী মোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ ছৈয়াল জানান, মজুচৌধুরীরহাট এলাকার মেঘনা নদীতে ১৬০টি নৌকা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার। কয়েকদিন আগে সরকারি বরাদ্দের কিছু চাল কয়েকজন জেলেকে দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ কম থাকায় তাদের সবাইকে সহযোগিতা করা যাচ্ছে না। সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানরা এগিয়ে এলে ভাসমান এসব পরিবারের ঈদ কিছুটা আনন্দের সাথে কাটতো।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহজাহান আলী জানান, জেলেদের বিজিএফ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ঈদ কেন্দ্রিক এসব ভাসমান জেলেদের জন্য কোনো বরাদ্দ থাকে না। 

এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম মহিব উল্যা জানান, অভিযানের সময় জেলেদের জন্য চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ভাসমান জেলেদের জন্য ঈদের সময় কোনো বরাদ্দ আসে না। 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর