বিপন্ন সপ্তপর্ণী উদ্ভিদ ছাতিম

ঢাকা, জাতীয়

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 20:56:56

শরৎ বা হেমন্তের সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি তীব্র মিষ্টি গন্ধ ছড়ায় ছাতিম ফুল। এ সময় পুরো গাছে গুচ্ছবদ্ধ সবুজাভ সাদা অসংখ্য ফুল ফোটে। অল্প বাতাসেই গাছতলায় ছোট ছোট ফুলে ভরে যায়। বলা হয় শীতের আগে ফোটা সর্বশেষ ফুল ছাতিম। এরপর শীতের আগে সাধারণত কোন ফুল ফুটতে দেখা যায় না।

ছাতিম Apocynaceae গোত্রের উদ্ভিদ। সারাবিশ্বে এর প্রায় ৪০-৬০টি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বড় বড় যে ছাতিম গাছ দেখা যায় সেটির বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris.

ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের আঙিনায় ছাতিম গাছ | ছবি: সুমন শেখ

ছাতিম গাছের পত্রটি যৌগিক পত্র। এর বৃন্তের গোড়ায় পাঁচ থেকে আট-নয়টি পর্যন্ত পত্রক থাকে। তবে সাধারণত এতে সাতটি পত্রক থাকায় সংস্কৃত ভাষায় একে সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণী উদ্ভিদ বলে। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে এটিকে ছাতিয়ান, ছাইত্তান, ছাইত্তান্না বা ছাতিম নামে ডাকা হয়।

ছাতিম গাছকে এ রূপ নামে ডাকা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ছাতিম গাছকে ইংরেজিতে ডেভিল’স ট্রি বলে। নামটি বাংলা করলে দাঁড়ায় শয়তানের গাছ। এ শয়তান শব্দটি অঞ্চলভেদে বিকৃত হয়ে ছয়তাইন্যা গাছ কিংবা ছাতিয়ান, ছাইত্তান, ছাইত্তান্না গাছ নামে ডাকা হয়।

ড. জসীম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্র আগে ছাতিম গাছ দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ছাতিম গাছ এখন বিপন্ন প্রজাতির। ঢাকায় হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় ছাতিম গাছ দেখা যায়। জায়গাগুলোর মধ্যে ঢাকার অফিসার্স ক্লাব, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ মিনার, উদয়ন স্কুলের কাছে, চামেরি হাউস, কার্জন হল, আব্দুল গণি রোড, নিকেতন (পুলিশ প্লাজার বিপরীতে), ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত অন্যতম।

ছাতিম ফুল

তিনি বলেন, গর্জন, তেলশুর, বৈলাম, রক্তনের মতো ছাতিমও একটি ‘টলেস্ট ট্রি’। এটি ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে ঢাকার ছাতিম গাছগুলো ৪০/৫০ ফুটের অধিক হবে না।

এর আদি বাসস্থান পূর্ব এশিয়ার চীন, ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং অস্ট্রেলিয়া। এমনকি এটি আফ্রিকায়ও দেখা যায়।

ছাতিম গাছকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে ড. জসীম বলেন, গাছটির তেমন বাণিজ্যিক মূল্য নেই। এ গাছের ফুল ও ফল বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বানর-হনুমানরা খায়। কাঠেরও তেমন বাণিজ্যিক মূল্য নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে ছাতিম গাছের কাঠকে বলা হয় ‘হোয়াইট চিজ উড’ বা শ্বেত নমনীয় কাঠ। জ্বালানি, হালকা আসবাবপত্র, লেখাপড়ার ব্ল্যাকবোর্ড, দিয়াশলাইয়ের বাক্স প্রভৃতি তৈরিতে ছাতিম গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়।


আমাদের দেশে গাছ অযত্ন অবহেলায় বড় হলেও পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উদ্ভিদ হিসাবে সম্মান দেওয়া হয়েছে ছাতিম গাছকে। তবে ভারতেও আগের মতো ছাতিম গাছ আর দেখা যায় না।

বাংলা সাহিত্য ও কবিতায় গুরুত্বসহকারে ছাতিম গাছের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে গাছটিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের উপাসনার জন্য রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণের আমন্ত্রণে রায়পুরে যান। সে সময় বোলপুরের এ স্থানটিতে দুটি ছাতিম গাছ দেখে তার নিচে বিশ্রাম নেন তিনি। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে তার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। সেখানে তিনি তার ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ লাভ করেন।


পরবর্তীতে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ২০ বিঘা জমি নিয়ে একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাড়িটির নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। সেই থেকে এ অঞ্চলটি শান্তিনিকেতন নামে পরিচিত।

সেকালের ছাতিম গাছ দুটি মরে যাওয়ার পর ওই একই জায়গায় আরো দুটি ছাতিম গাছ রোপণ করা হয়। গাছ দুটিকে কংক্রিটের ঘের দিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। দক্ষিণ দিকের গেটে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ কথাটি লেখা রয়েছে।

পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ছাত্রছাত্রীদের সপ্তপর্ণী তথা ছাতিম গাছের পাঁচটি পাতার গুচ্ছ উপহার হিসেবে দেওয়া হয়।


ছাতিম চিরসবুজ বৃক্ষ। গাছের পুরু ছালের ভিতরটা সাদা ও দানাযুক্ত, উপরটা খসখসে, গোটা গাছে সাদা দুধের মতো আঠা আছে। গাছটিতে শীতকালে সরু বরবটির মতো ফল হয়।

উইকিপিডিয়ায় ছাতিমের ওষুধি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। ছাতিমের কষ বা আঠা অনেকে ঘা বা ক্ষতে লাগিয়ে থাকেন। এর বাকল বা ছাল ওষুধের কাজে ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়ে এটি অত্যন্ত উপকারী। জ্বর ধীরে ধীরে নামায় বলে ম্যালেরিয়াতেও উপকারী। চর্মরোগেও ছাতিম ফলপ্রদ।

বাণিজ্যিক মূল্য নেই বলে ছাতিমকে কেউ তাদের বাগানে বাড়ির পাশে কিংবা রাস্তার ধারে লাগায় না। নার্সারিতেও ছাতিম গাছের চারা পাওয়া যায় না। অযত্নে অবহেলায় গাছটি বেড়ে ওঠে। জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় গাছটি রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর