সুপারিশ না নিয়ে সড়ক আইন, উৎকণ্ঠায় শাজাহান খান

ঢাকা, জাতীয়

শাহজাহান মোল্লা ও রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 09:04:37

বহু বছরের পুরনো মোটরযান অধ্যাদেশ বাতিল করে তৈরি হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে আলোচিত এই আইনটি। নতুন আইন কার্যকর করতে সকল প্রস্ততি শেষ করেছে  বিআরটিএ, পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।


তবে সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতা সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান।

তিনি জানান, সুপারিশ গ্রহণ না করে আইন বাস্তবায়ন হলে, মালিক শ্রমিকদের উৎকণ্ঠা এক সময় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।


সংসদ ভবনে তার নিজস্ব কার্যালয়ে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বুধবার (৩০ অক্টোবর) সড়ক পরিবহন আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন শাজাহান খান।

নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি দেশেই সব সেক্টরে আইন থাকে। তেমনি আমাদের দেশেও সড়ক পরিবহন আইন ছিলো। ১ নভেম্বর থেকে নতুন করে আরেকটা আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট নামে একটি আইন ছিল। সেই আইনটি ১৯৮৪ সালে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির প্রেক্ষিতে কিছু সংশোধন করে মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট ১৯৮৩ নামে  আইন করা হয়েছিল। কিন্তু মৌলিক দিকগুলো তেমন পরিবর্তন হয়নি। আমরা সব সরকারের কাছে বলেছি যুগোপযোগী একটা আইন দরকার। কেননা ১৯৩৯ সালে যে যানবাহন ছিল, আর তখনকার পরিস্থিত আর এখনকার পরিস্থিতি এক না।

শ্রমিক নেতা সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান

নতুন আইন প্রসঙ্গে শাজাহান খান বলেন, প্রায় ৫-৬ বছর ধরে এই আইনের খসড়া তৈরি করে বিভিন্ন মহলের মতামত নেওয়া হয়েছে। পরিবহন শ্রমিক, মালিক, বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে ওয়ার্কশপ করা হয়েছে। নতুন আইন যখন আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং এর জন্য পাঠানো হয় তখন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মতামত নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। তাদের মতামত নিয়েই আইনটা তৈরি হয়। তবে আইনটা যখন চূড়ান্তভাবে আনা হলো দেখলাম মালিক শ্রমিকের সুপারিশ ছিল তার কিছু কিছু অংশ পরিবর্তন হয়েছে। এরপর আমরা যে বিষয়গুলোর পরিবর্তন দরকার তার কয়েকটি বিষয় যৌক্তিকভাবে তুলে ধরলাম। তখন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে কমিটি করলেন। কমিটিতে আইনমন্ত্রী এবং রেলপথমন্ত্রীও ছিলেন। সেই কমিটি ‍দুই তিন দফা বৈঠক করে আমাদের দাবি যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছে। আমাদের প্রস্তাবগুলো পরিবর্তন করতে একমতও হয়েছে।

তবে আইনটা বাস্তবায়ন না করলে সংশোধন হবে কি করে? এই অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন করার। যদিও আইন নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে মালিক শ্রমিকরা।

আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এই শ্রমিক নেতা বলেন, আইনে নিয়োগপত্রের বিধান আছে, কিন্তু নিয়োগপত্র দেন না মালিক। নতুন করে এই আইনের মধ্যে প্রস্তাব করেছিলাম নিয়োগপত্র না দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ হবে। কিন্তু কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটা এই আইনের মধ্যে নাই। তখন আলোচনা করে তিনমন্ত্রী একমত হলেন মালিক যদি নিয়োগপত্র না দেন তাহলে তার ৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। আইনে আছে, ওভার লোডিং করলে ৩ বছরের জেল ৩ লাখ টাকা জরিমানা। এটা অযৌক্তিক। এ ক্ষেত্রে আমরা বলেছি এক বছরের জেল এক লাখ টাকা জরিমানা।  তবে এটাকেও তারা যৌক্তিক মনে করেন।

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ নিয়ে বার্তাটোয়েন্টিফোরের একান্ত সাক্ষাৎকারে শাজাহান খান

আইনে আরেকটা বিষয় আছে যানবাহন নির্মাণের নির্দেশনা। ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহন তৈরির প্রকৌশলগত দিক ঠিক করতে হবে। এখানে আইনে এরজন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে জামিন অযোগ্য। যেটা আইনের ৮৪ ধারায় আছে। আমরা বলেছি, জামিনযোগ্য হওয়া দরকার।

চালক ও কন্ট্রাক্টরের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে শাজাহান খান বলেন, আইনে আছে ড্রাইভার হতে ৮ম শ্রেণি পাস হতে হবে এবং কন্ট্রাক্টর হওয়ার জন্য হতে হবে ৫ম শ্রেণি পাস। এখন প্রশ্ন একজন কন্ট্রাক্টর বা সুপারভাইজার যদি দীর্ঘদিন গাড়িতে কাজ করতে করতে ড্রাইভার হয়।তিনি একজন দক্ষ ড্রাইভারও হতে পারেন। তাহলে সেই ড্রাইভারের সার্টিফিকেট কোথায় পাবেন? ৮ম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট তিনি কোথায় পাবেন? সেজন্য আমরা বলেছি এদের ক্ষেত্রে আইনের শিথিলতা দরকার। যদিও কমিটি এটা মেনে নিয়েছে।

চালকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকুক এটা কী চান না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন শিক্ষিতের হার বেড়ে গেছে। একদম অশিক্ষিতকে এই সুযোগ দেওয়া ঠিক না।

সড়ক পরিবহন আইনের একটি ধারা তুলে ধরে তিনি বলেন, আইনে আরও আছে দুর্ঘটনার কারণে ৫ বছর জেল, ৫ লাখ টাকা জরিমানা-এটা ঠিক আছে। তবে আমাদের দাবি হচ্ছে জামিনযোগ্য করা। সেখানে আইনে আছে ৩ বছরের অধিক সাজা হলে সেখানে জামিনযোগ্য করার সুযোগ নাই। তাহলে এদেরকে কি করা যাবে। এমনিতেই দেশে ড্রাইভারের সংকট রয়েছে। লাখ লাখ ড্রাইভারের ঘাটতি।

এ বিষয়ে একটা যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ধরেন যদি প্রতি বছর আড়াই হাজার বা তিন হাজার দুর্ঘটনা ঘটে এই দুর্ঘটনা ঘটার পর যদি আড়াই হাজার তিন হাজার ড্রাইভার জেলে যায় আর যদি জামিন না হয় তাহলে গাড়িটা চালানোর লোক কোথায়? দেশে ড্রাইভিং স্কুল কয়টা আছে? বিআরটিএ নিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুল আছে ১২৩টি। সেখান থেকে বছরে ড্রাইভার বের হয় ১৫ হাজার আর মোটোরসাইকেলসহ গাড়ি নামে ৫০ হাজারের মতো। তাই আমরা বলেছিলাম যারা আছে তাদের জন্য বিষয়টা শিথিল করতে।

তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, এক মাসের মধ্যে নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় এতবড় সুপারিশ আগে কেউ দিতে পারেনি। আমরা ৭টি বিষয়কে বিশ্লেষণ করে ১১১টি সুপারিশ দিয়েছি। তার মধ্যে রয়েছে-সচেতনতা, দক্ষতা, শিক্ষা ব্যবস্থা। যানবাহনের প্রকৌশলগত দিক কিভাবে নির্মাণ হবে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইনে যা আছে সেটাই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। কেউ যদি বলে আমার ইচ্ছামত চলব, এটা চলবে না। যদি একটা দুর্ঘটনা ঘটে পুলিশ রিপোর্ট দেয়-ড্রাইভারের দোষ। কিন্তু, দুর্ঘটনা রিপোর্ট বলে এককভাবে ড্রাইভারের কারণে ঘটেনি। আইনটাকে যথাযথভাবে যৌক্তিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলো মূল কথা। সুপারিশ দিলাম, সুপারিশ বাস্তবায়ন হলো না-এটা তো হয় না। যদিও এবার সুপারিশ আমলে নিয়ে আইন কার্যকর করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।


তিনি বলেন, আমাদের যৌক্তিক প্রস্তাবগুলো ওনারা (মন্ত্রণালয়ের কমিটি) যেভাবে মেনে নিয়েছেন সেটা যদি হয় তাহলে তো আর সমস্যা নাই। তবে এসব নিয়ে শ্রমিক মালিকদের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় তাদের উৎকণ্ঠা পরিপক্ক হবে এবং তখন দেখা যাবে এটা নিয়ে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।


শাজাহান খান বলেন, শ্রমিক মালিক সকলের ত্রুটি আছে। আমি বলছি না শ্রমিকের কোনো দোষ নাই, ড্রাইভার ও মালিকের কোনো দোষ নাই। যার যতটুকু দোষ সেইটুকুর দায় তার নিতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর