বাংলাদেশকে আঘাত করা ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়গুলো

ঢাকা, জাতীয়

রকিবুল সুলভ,নিউজরুম এডিটর,বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 13:39:14

ভূ-প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের দক্ষিণে রয়েছে বিশাল বঙ্গোপসাগর, যা ভারত মহাসাগরের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে বাংলাদেশের ওপর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রতিবছরই আঘাত হানে। এসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবকাঠামোগত ক্ষয়-ক্ষতিসহ অনেক প্রাণহানিও ঘটে থাকে। বাংলাদেশ সরকার এসব ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে।

গত দুই-তিনশ বছরে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম পাওয়া যায়, যেগুলো এই অঞ্চলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাংলাদেশের সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬০-২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩টি বড় সাইক্লোনের ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়।

এদের মধ্যে আলোচিত কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের পাঠকদের জানাতে এই আয়োজন।

১৮৭৬ সালের ঘূর্ণিঝড় :

প্রায় দেড়শ বছর আগে একটি ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলে আঘাত হানে, যাকে ভয়াবহতার দিক থেকে পৃথিবীর ষষ্ঠ ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম 'বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়'। বাকেরগঞ্জের উপকূলের (মেঘনার মোহনার ‍নিকটে) ওপর দিয়ে বয়ে যায় এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। এতে বাতাসের তীব্রতা ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার।

এতে পানি সমুদ্রতটের থেকে স্বাভাবিকের থেকে ৪০ ফিট উপর দিয়ে বয়ে যায়। এই ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সঙ্গে প্রাণহানিও ঘটে। ধারণা করা হয় যে, এই ঝড়ে প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ভয়াবহ মহামারি ও দুর্ভিক্ষের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগে এই অঞ্চলের মানুষের।

১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড় :

১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর ভোলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ঘূর্ণিঝড় ছিল এ অঞ্চলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘূর্ণিঝড়। রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি এটি। এটি ১৯৭০-এর উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ৬ষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচিত।

১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত একটি এলাকা/ ছবি: এপি 

সিম্পসন স্কেলে 'ক্যাটাগরি ৩' মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার। হিসেব অনুযায়ী এতে প্রায় ৩ থেকে ৫ লাখ মানু্ষের প্রাণহানি ঘটে। এই ঝড়ের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোলা জেলা। সেখানকার তজমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজারই প্রাণ হারান সেদিন।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় :

এই ঘূর্ণিঝড়কে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২০তম বছরে এসে বাংলাদেশ দেখে এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়টি। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। এতে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল।

এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক যাদের অধিকাংশই ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। সচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেকেই সাইক্লোন সেন্টারে সময়মত আশ্রয় নেয়নি। ধারণা করা হয় প্রায় ২০ লাখ লোক আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়।

এই ঘূর্ণিঝড় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের (১৯৯১ মার্কিন ডলার) ক্ষতি সাধন করে। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান ও আকাশ নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও বিদ্যমান। এই ঝড়ে প্রায় ১০ লক্ষ ঘড়-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যাতে প্রায় ১ কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়।


ঘূর্ণিঝড় সিডর :

আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি সমুদ্রে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম 'সিডর'। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে এটি। এতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। এই ঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১৮-২০ ফুট। এই ঝড়ে প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

সাইক্লোন সিডরের ক্ষয়ক্ষতি/ ছবি: সংগৃহীত 

রেডক্রসের তথ্যানুযায়ী, এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। সুন্দরবনের বেশ ক্ষতি হয় এতে। ঝড়ে ২১০,০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬০০,০০০ টন ধান বিনষ্ট হয়। সুন্দরবনের পশুর নদীতে বেশ কিছু হরিণের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়। এ ঝড়ে প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়।


ঘূর্ণিঝড় আইলা :

২০০৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় 'আইলা'। ওই বছরের ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড়টির উৎপত্তি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে এই ঝড় আঘাত হানে ২৫ মে। এই ঝড় ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশেও আঘাত হানে। 

ঘূর্ণিঝড় আইলা শেষে ত্রাণ নিয়ে ফিরছেন ক্ষতিগ্রস্ত নারী/ ছবি: সংগৃহীত

মালদ্বীপের আবহাওয়াবিদরা আইলা'র নামকরণ করেন। আইলা'র অর্থ ডলফিন বা শুশুকজাতীয় জলচর প্রাণী। এই প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ব্যাসের ঘূর্ণিঝড়টি প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। তবে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে যাওয়ায় বাতাসের গতিবেগ কমে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার হয়ে যায়। এতে সিডরের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছিল। কেননা এই ঝড়ের পূর্বে নেয়া হয় বেশ কিছু প্রস্তুতি।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন :

বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে নিম্নচাপজনিত কারণে ২০১৩ সালের মে'র শুরুর দিকে উৎপত্তি ঘটে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের। এতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কার্যত জনজীবন অচল হয়ে পড়ে।

ঘূর্ণিঝড় মোরা:

২০১৭ সালের ৩০ মে সকাল পৌনে ৬টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফে ১৩৫ কিমি বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় 'মোরা'। এসময় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপকূলে ১০ নম্বর মহা বিপদসংকেত জারি করা হয়। এছাড়া এতে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর সংকেত দেখাতে বলা হয়। এই ঝড়ের আঘাতে কক্সবাজার উপকূলের শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়। বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটে এতে।


ঘূর্ণিঝড় ফণী:

২০১৯ সালের ৪ মে সকালে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা অঞ্চল এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। তবে আঘাতের পূর্বেই এটি দুর্বল হয়ে যায়। ফণীর প্রভাবে ও আঘাতে বাংলাদেশে মোট ১৮ জনের মৃত্যু হয়।

ঘূর্ণিঝড় ফণীতে আক্রান্ত একটি পরিবার/ ছবি: আল জাজিরা 

বাংলাদেশ সরকার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য চাল, শুকনো খাবার, এবং ৳১.৯৭ কোটি বিতরণ করে। ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে বাংলাদেশে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয় জানায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর