‘দাফনের সময়ও মেয়েকে দেখতে পেলাম না’

ঢাকা, জাতীয়

সাদিয়া কানিজ লিজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 06:18:37

স্বামী আর দুই সন্তান নাফিজুল হক নাফিস আর আদিবা আক্তার সোহাকে নিয়ে সুখেই কাটছিল নাজমা আক্তার ও মহিন আহমেদ সোহেলের সংসার। সংসারকে আরও সচ্ছল করতে চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছিলেন দম্পতি। কিন্তু হঠাৎ ট্রেন দুর্ঘটনা কেড়ে নিল ছোট্ট মেয়ে সোহাকে। স্বামী-স্ত্রী দুজন এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দিন গুনছেন কবে সুস্থ হবেন।

বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু হাসপাতাল) মহিলা ওয়ার্ডে কথা হয় নাজমা আক্তারে সঙ্গে। নিজের শারীরিক অক্ষমতা আর সন্তান হারানোর যন্ত্রণা যেন শোকে পাথর করে দিয়েছে তাকে।

বেডে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে নাজমা বলেন, ‘আমার এমনই অবস্থা যে, আমার মেয়ের দাফন হলো, কিন্তু শেষ দেখা হলো না। আমার তো সব শেষ, নিঃস্ব হয়ে গেলাম আমি। বুকে চেপে ধরে রেখেও আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম না।’

হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন নাজমা আক্তারের স্বামী মহিন আহমেদ সোহেল

দুর্ঘটনার ভয়াবহতার কথা বর্ণনা দিয়ে নাজমা বলেন, ‘হঠাৎ করে একটি শব্দ হলো আর কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল চারপাশ। এক মিনিটের মধ্যেই যা হবার হয়ে গেল। তখনো আমার মেয়ে আমার বুকে, চেপে ধরে রেখেছিলাম শক্ত করে। ট্রেনের উপরের অংশগুলো ভেঙে আমার মেয়ের ওপর পড়তেই রক্তাক্ত হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম আমার সোহা মা আর বেঁচে নেই। তখন আমার দুপা ট্রেন থেকে কিছুটা বেরিয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম আমার দুপা কিছু একটার নিচে চাপা পড়ে আছে। আমার স্বামী ছিল সামনের সিটে তার অবস্থাও খারাপ।’

মেয়ে আদিবার স্মরণে নাজমা বলেন, ‘আমার মেয়ে সবার সঙ্গে মিশে যেত। তাই ওকে সবাই আদর করত। সোহা সাজতে ভালোবাসতো তাই দ্রুতই ওর কান ফুটো করে দিয়েছিলাম, কানের দুল কিনে দিয়েছিলাম। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, পড়াশোনা করাব ভবিষ্যতে ও ভালো কিছু করবে। ওর বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিলাম সোহা। আমার ছেলেটা একটু দুষ্টু কিন্তু মেয়েটি আমার অনেক শান্ত ছিল। আমরা সবাই ওকে আদর করে সোহামনি বলে ডাকতাম।’

নাজমা জানান, সম্প্রতি তার স্বামীর ব্যবসায় লস হাওয়ার কারণে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং ছেড়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমান। সেখানে ইয়ংওয়ান নামের কোরিয়ান একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন মহিন আহমেদ সোহেল ও নাজমা আক্তার। সেখানে ভাড়া বাসায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতেন তারা। সঙ্গে থাকতেন নাজমার মা রেনু আক্তার। তিনিও এখন হাসপাতালে ভর্তি।

হাসপাতালে দেখাশোনা করছেন নাজমার খালা

বর্তমানে আহত থাকায় ভবিষ্যতে চাকরি থাকবে কিনা এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন নাজমা। অফিস থেকে খোঁজ নিলেও তাদের কাছ থেকে এখনো কোনো সাহায্য পাননি বলেও জানান তিনি।

এদিকে নাজমার পাশের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন একই দুর্ঘটনায় আহত সুরাইয়া খাতুন। কথা বলার সক্ষমতা এখন তার নেই। মেয়ে জাহেদা খাতুন ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, তা এখনো জানেন না তিনি।

তার ছেলের বউ নিলুফা জানান, দুর্ঘটনার দিন মেয়ে আর চার নাতি-নাতনি নিয়ে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী ‘উদয়ন এক্সপ্রেস' ট্রেনে উঠেছিলেন সুরাইয়া। দুর্ঘটনায় তারাও হাসপাতালে ভর্তি।

আহতদের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে পঙ্গু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘নাজমা অবস্থা এখন উন্নতি হচ্ছে। তার দু’পায়ের সমস্যা ছিল এবং বাম হাত ভাঙা। তবে এখন কিছুটা ভাল। তবে তার স্বামী কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। কাল রাত থেকে উনার পেটে ব্যথা লক্ষ্য করছি। পরিবারের লোকজন লিভার জনিত সমস্যার কথা বলছেন। তবে এটা আগে থেকেই ছিল নাকি আঘাতের জন্য হল, এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। এরমধ্যে যদি বেশি সমস্যা হয় তবে আমরা হয়তো দু-এক দিনের মধ্যেই তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠাব।’

হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন একই দুর্ঘটনায় আহত সুরাইয়া খাতুন

সুরাইয়া খাতুনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনার বয়সের তুলনায় যেভাবে আঘাত পেয়েছেন তাতে উনাকে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ধরে নিচ্ছি। এমনিতে আঘাত তেমন সিরিয়াস নয়, তবে ভয়টা বয়সের জন্য। ডান পা এবং বাম পা দুটি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া বুকে এবং পেটে আঘাত পেয়েছে। সব মিলিয়ে আমরা থাকে বিশেষ নজরে রেখেছি।’

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দভাগ স্টেশন এলাকায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা-নিশীথা ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৬ জন নিহত হন এবং ৭৪ আহত হন। আহতদের ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর