৩০ বছর আগে আসামিদের বাঁচাতে চেয়েছিল পুলিশ

ঢাকা, জাতীয়

শাহরিয়ার হাসান ও মনি আচার্য্য, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-25 01:44:32

সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড, যার রহস্য উন্মোচন হতেই কেটে গেছে ৩০ বছর। কিন্তু এই রহস্য এতদূর না গড়ালেও পারত। ১৯৮৯ সালের সেই হত্যাকাণ্ডে কেবলমাত্র রমনা থানা পুলিশের সহায়তায় বেঁচে গিয়েছিল আসামিরা। এ কারণেই হত্যা রহস্যের জট খুলতে এতটা সময় কেটে গেছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত বলছে, রমনা থানা পুলিশের সহায়তায় আসামিরা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর এ কারণেই সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার তদন্তে সঠিক তথ্য উঠে আসেনি।

পিবিআই’র কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য মতে, এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল একজন রিকশাচালক। নাম তার আব্দুস সালাম। এই ব্যক্তিকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হলে রমনা থানা পুলিশ তাকে ঘটনার বিস্তারিত জানাতে নিরুৎসাহিত করে। আর এতেই পুলিশের কাছে কাজটি সহজ হয়ে যায়। আব্দুস সালামকে আড়াল করে, সহজেই ঘটনাটিকে ছিনতাই জনিত হত্যাকাণ্ড বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঘটনার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৯০ সালে সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় মন্টু নামে একজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের সময় দু'জন ঘটনাস্থলে থাকলেও আসামি একজন কেন- এই প্রশ্ন আদালতের সামনে আসে। এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে সন্ত্রাসী মারুফ রেজার নাম এলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালে মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করেন মারুফ রেজা। এরপর আদালতের আদেশে থেমে যায় সব ধরণের তদন্ত কাজ।

হাইকোর্ট/ ছবি: ‍সংগৃহীত

এরপর ফাইলবন্দি অবস্থায় এই মামলার ২৮ বছর কেটে যায়। চলতি বছরের ২৬ জুন মামলার ওপর স্থগিতাদেশ তুলে নেন হাইকোর্ট। ১১ জুলাই অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত কর্তৃক মামলাটির দায়িত্বভার এসে পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই এর ওপর।

ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ পিবিআই’য়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে তদন্তের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন।

শাহাদাত হোসেন বলেন, অনেক কষ্টের পর আমরা সগিরা মোর্শেদ যে রিকশায় খুন হয়েছিলেন, সে রিকশাচালককে খুঁজে বের করি। তাকে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করি।

জিজ্ঞাসাবাদে রিকশাচালক সালাম পিবিআইকে বলেন, ঘটনার দিন দু'জন ব্যক্তি ৩-৪টা গুলি করে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে তিনি একাই একটি ইট নিয়ে ছিনতাইকারী ছিনতাইকারী বলে ধাওয়া করেন। তাদের ধরতে না পারায় সরাসরি রমনা থানাতে চলে যান। পরে পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর রিকশাসহ সালামকে থানাতে নিয়ে যায় পুলিশ। থানায় দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর, এসব কথা (কে কে গুলি করেছে সে ব্যাপারে) কাওকে না জানাতে বলে। এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।

পিবিআই’য়ের এই বিশেষ পুলিশ সুপার বলেন, পরবর্তীতে মামলার দীর্ঘকালীন তদন্তে ডিবি পুলিশের ২৫ জন কর্মকর্তা কাজ করেন। কিন্তু এবার পিবিআই সালামের কাছে ঐ গুলি ছোঁড়া দুই ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চায়। তখন তার বর্ণনায়, একজন লম্বা আর একজন খাটো মানুষের কথা উঠে আসে।

ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ পিবিআই’য়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন ও মামলার সরাসরি তদন্তকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম 

চালক সালাম পিবিআইকে ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, প্রথমে ব্যাগ নিয়ে টান দেওয়ার পরই, সগিরা মোর্শেদ লম্বা একজনকে নাম ধরে ডাকেন। সগিরা বলেন, 'আমি আপনাকে চিনি'। আর এই কথাগুলোই জানাতে নিষেধ করেছিল সে সময়ের রমনা থানা পুলিশ।

বিশেষ পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, তদন্ত চলার ১১২তম দিনে আমরা এইসব তথ্য পাই। এরপর অনেক কৌশল অবলম্বন করে সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী- সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের ভাই আনাস মাহমুদ রেজওয়ান ও সন্ত্রাসী মারুফ রেজাকে আমরা হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রমাণ করি।

খুনের অভিযুক্ত মারুফ রেজার কথা পুলিশ গোপন করতে বলেছিল কেন? জানতে চাইলে পিবিআই তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেন, তৎকালীন (১৯৮৯) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় ছিলেন এই মারুফ রেজা। তার পূর্বের রেকর্ডও ভাল ছিল না। তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন।

মামলাটির সরাসরি তদন্তকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, সে সময় রমনা থানা পুলিশ ইচ্ছে করেই রিকশাচালক সালামের কথা শুনেনি। এমনকি তাকে এই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে নিষেধ করেছে। সালাম এখন বুঝতে পারছেন এই হত্যা মামলায় তার এই তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এই তথ্যগুলোই ঘটনার ৩০ বছর পরও হত্যাজট খুলতে সাহায্য করেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর