‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যের বেহাল দশা

ঢাকা, জাতীয়

সাদিয়া কানিজ লিজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-09-01 09:13:43

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফুলার রোডের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা বাঙালি জাতির মহিমান্বিত সংগ্রামের ইতিহাস বহন করে। ভাস্কর্যটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর তার মাথার উপর দিয়ে লাল সবুজ পতাকা উড়ছে সগৌরবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের নজরদারি আর সংস্কারের অভাবে সেই ভাস্কর্যের এখন বেহাল দশা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভিযোগ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ এগুলো নষ্ট হতে বসেছে।

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। বাঙালি জাতির বিভিন্ন সংগ্রামের চিত্র এ ধরনের ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উন্মোচন করতেই ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করেছিলেন ভাস্কর শামীম শিকদার।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মূল ভাস্কর্যের পাদদেশে রাখা ছোট ছোট ভাস্কর্যগুলোর চুনকাম উঠে গিয়ে জরাজীর্ণ অবস্থা। কয়েকটি ভেঙেও গেছে। কয়েকটিতে নামফলক নেই। আর যেগুলোর নামফলক আছে সেগুলোও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এছাড়া বড় ভাস্কর্যটিতে অনেক আগাছাও জন্মেছে। আর সেখানের লাইটিং ব্যবস্থাও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য

দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনগুলোতে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ ভাস্কর্য চত্বরটি খোলা থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ সময় এই চত্বর বন্ধ থাকে বলে অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এছাড়া চত্বরের ভেতরে একটি তথ্য কেন্দ্র থাকলেও তা অধিকাংশ সময় তালাবদ্ধ থাকে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানী বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘সবগুলো ভাস্কর্যই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য বহন করে। অবশ্যই এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। এ বিষয়ে আমি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবো।’

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলার কারণেই এগুলোর আজ বেহাল দশা।রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আমাদের এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা সত্যিই দুঃখজনক।’

শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন মাহি বলেন, ‘আসলে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির দিকে তাদের খেয়াল কম। আমাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর প্রতি অবহেলা খুবই হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই এগুলোর তদারকি করতে পারে। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর প্রতি তাদের অনাগ্রহের কারণেই এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য

ডাকসুর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘তথ্য সংগ্রহ করে আমরা সবগুলো ভাস্কর্যের একটা তালিকা তৈরি করছি। শেষ হলেই আমরা ভিসি স্যারের কাছে একটি প্রস্তাবনা জমা দিবো। এগুলো সংস্কারের পাশাপাশি নামফলক যুক্ত করার সুপারিশ করা হবে।’

তথ্যকেন্দ্র বন্ধ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তথ্যকেন্দ্র অবশ্যই খোলা থাকতে হবে। সেখান থেকেই তো মানুষ তথ্য সংগ্রহ করবে। এটা বন্ধ থাকা উচিত নয়।’

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য

ভাস্কর্যটি মহান ভাষা অন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬-র স্বাধীকার আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এসব আন্দোলনে নিহত ১৮ জন শহীদের মুখচ্ছবি দিয়ে পুরো ভাস্কর্য নির্মিত। সবার নিচে ভাষা শহীদের ভাস্কর্য এবং সবার উপরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। এতে আরও যুক্ত আছে বাংলাদেশের পতাকা।

জরাজীর্ণ ফলক

বড় ভাস্কর্যটি স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘিরে, আর এটিকে কেন্দ্র করে আরও ছোট ছোট মোট ১১৬টি ভাস্কর্য রয়েছে। এসব ভাস্কর্যের কোনটি এককভাবে স্থান পেয়েছে আবার কোনটি যুক্তভাবে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মহাত্মা গান্ধী, তাজউদ্দিন আহমেদসহ দেশি-বিদেশি অনেক গুণীজনের ভাস্কর্য। আছে হাতির ভাস্কর্য। এছাড়াও রয়েছে ভাস্কর শামীম সিকদারেরও দুটি প্রতিকৃতি। মূল ভাস্কর্যের উচ্চতা ৭০ ফুট, আর অন্যান্য ভাস্কর্যগুলোর গড় উচ্চতা ৩-৪ ফুট।

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য

শামীম শিকদার ১৯৮৮ সালে প্রথমে ফুলার রোডে প্রোভিসির ভবনের সামনে খালি জায়গায় ‘অমর একুশে’ নামে একটি বিশাল ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে ওই স্থানে উদয়ন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হলে ভাস্কর্যটি স্থানান্তর করে জগন্নাথ হলের পেছনে, বুয়েট সংলগ্ন ফুলার রোডের এই স্থানে রাখা হয়। পরে তিনি ওই ভাস্কর্যটির গঠন পরিবর্তন করে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নাম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে নতুনভাবে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর