বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত ও নিকৃষ্ট জঙ্গি হামলা হয় হলি আর্টিজান বেকারিতে। যে হামলা পুরো দেশসহ স্তম্ভিত করে দেয় বিশ্বকে। হামলার আগ মুহূর্তেও কারও ধারণা ছিল না অভিজাত এলাকা গুলশানে পবিত্র রমজান মাসে এমন নৃশংস হামলা হতে পারে।এ ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত দেশসহ সারাবিশ্বের মিডিয়াতে গুরুত্ব সহকারে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।
এ হামলায় ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বিশ্ব মিডিয়ায় বেশ প্রশংসিত হয়। তবে এই প্রশংসা ঢাকা পড়ে ২৪ জন নিহতের খবরে। হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুরো দেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। দীর্ঘ পরিক্রমায় দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে সক্ষম হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
হামলার পরিকল্পনা যেভাবে করা হয়
১ জুলাই হামলা হলেও প্রস্তুতি আগেই নিয়েছিল জঙ্গিরা। ২০১৬ সালের মার্চে তামিম আহমেদ চৌধুরী ও শরিফুল ইসলাম খালেদ এই হামলার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে কূটনৈতিক এলাকায় হামলার সিদ্ধান্ত হয়, পরে বিদেশিদের অবস্থান যেখানে সবচেয়ে বেশি সেখানে হামলার পরিকল্পনা নেয় জঙ্গিরা।
এ জন্য ৫ জঙ্গিকে আত্মঘাতী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হামলার মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন তামিম চৌধুরী। হামলার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁটি রেকি করা হয়। হামলার জন্য বেছে নেওয়া হয় মুসলিম উম্মার সবচেয়ে পবিত্র শবে কদরের রাতটিকে। গুলি বর্ষণ করতে করতে জঙ্গিরা হলি আর্টিজানে প্রবেশ করেন। ঘটনাস্থলেই শুরুতেই আঘাত প্রাপ্ত হন দুই কনস্টেবলসহ এক পথযাত্রী।
যেভাবে খবর পায় পুলিশ
দুই কনস্টেবল আহত হওয়ার পরপরই পুলিশ খারাপ কিছু সন্দেহ করতে থাকে। পুরো রেস্তোরাঁটি তখন ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এতে গুরুতর আহত হন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসি রবিউল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তারা।
রাত ১১টার দিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান ‘ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমরা বিপথগামী হামলাকারীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি।’
অভিযানে সশস্ত্রবাহিনী
রাত ১২টায় পুলিশ, র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে অভিযানে অংশ নিতে ঘটনাস্থলে আসে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরা। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’।
জঙ্গিদের ভেতরের কর্মকাণ্ড রাত দেড়টার দিকে খবর পাওয়া যায় জঙ্গিরা রাতেই ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। এর মধ্যে নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানের ও একজন ভারতীয় নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি ছিল।
‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ অভিযানে যা ঘটেছিল
সারারাত জঙ্গিদের সুযোগ দেওয়া হয় আত্মসমর্পণের জন্য। কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকায় ২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ পরিচালনা করা হয়। মাত্র ১৫ মিনিটের অভিযানেই ৫ জঙ্গি নিহত হন।
আটকে পড়াদের উদ্ধার অপারেশন থান্ডার বোল্ট শেষে রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে একজন জাপানি, দু’জন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ওই সময় সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী হিসেবে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ১২ ঘণ্টার এ জিম্মি ঘটনায় নিহত হন ২৪ জন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি।
নিহত হয়েছিলেন যারা
এই হামলায় ২৪ জন নিহত হন। এর মধ্যে নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয় নাগরিক।
এছাড়া একজন বাংলাদেশ-আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক, দু’জন সাধারণ নাগরিক, হলি আর্টিজানের দুই কর্মচারী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয় অন্তত ২০ পুলিশ সদস্য।
যেভাবে রায়ের পর্যায়ে হলি আর্টিজান মামলা
হামলার ৩ দিন পর ৪ জুলাই গুলশান থানায় মামলা হয়। পুলিশের উপ-পরিদর্শক রিপন কুমার দাস নিহত ৫ জঙ্গিসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করা হয়। এই মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবিরকে।২০১৮ সালের ১জুলাই নব্য জেএমবিসহ ২১ জনকে অভিযুক্ত করে জীবিত ৮ জনের জন্য বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।
জীবিত ৮ আসামির মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আসামিদের মধ্যে শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশীদ পলাতক ছিলেন। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ৮ আসামির বিরুদ্ধে আদালত চার্জ গঠন করার পর মামলাটির আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। এরপর ৫২ কার্যদিবসে সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক গ্রহণ শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
মামলার আসামি যারা ছিলেন
নব্য জেএমবি নেতা, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী হাদিসুর রহমান সাগর, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল, নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক শাখার প্রধান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান মাহফুজ, মামুনুর রশিদ ও শরিফুল ইসলাম।
সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ
২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। প্রায় ১ বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য ও জেরার মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। ৩০ অক্টোবর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন ও পরবর্তী ৫টি তারিখে যুক্তিতর্ক গ্রহণের মাধ্যমে মামলাটি রায়ের জন্য প্রস্তুত হয়। এ সময় চার্জশিটের ২১১ সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল।
২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা
হলি আর্টিজান বেকারিতে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলা মামলার রায়ে ৭ আসামির ফাঁসির নির্দেশ দেন আদালত। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। চার্জশিটভুক্ত ৮ আসামির মধ্যে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে এক আসামিকে খালাস দেন আদালত।