একেএম সিরাজুল হক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর গেরিলা দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহের পলাশকান্দা গ্রামে সম্মুখযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন সিরাজ। পরে পাকবাহিনী তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর কেটে গেলেও সিরাজের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র পায়নি পরিবার। এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায়নি তার পরিবার। এ নিয়ে সিরাজের ছোট ভাই একেএম এমদাদুল হকের আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
রোববার (১ ডিসেম্বর) বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা অনুসন্ধানে নামার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। জানা গেছে, ভারতীয় লালমুক্তিবার্তা ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একেএম সিরাজুল হকের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। তালিকাভুক্তির বিষয়টি বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমাণ্ডার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম।
তিনি বলেন, লালমুক্তিবার্তা ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একেএম সিরাজুল হকের নাম রয়েছে। তার লালমুক্তিবার্তা ক্রমিক নং ০১১৫১০৩২৪ ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে ক্রমিক নং ৫০৪৮।
একেএম সিরাজুল হক সিরাজের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে। তার বাবা মৃত মনফর উদ্দিন। মাতা মৃত ফিরুজেন্নসা। তিন ভাই এক ও বোনের মধ্যে সিরাজ ছিলো সবার বড়।
সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে চলে যান সিরাজ। যোগদেন মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দলে। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর মুজিব বাহিনীর কমাণ্ডার মো. মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দল ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী পাক হানাদার বাহিনীর কনভয়ে হামলা করার জন্য গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জের সীমান্তবর্তী পলাশকান্দা গ্রামে অবস্থান নেয়। প্রায় ৪০ সদস্যের মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা দলে ছিলেন একেএম সিরাজুল হক।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে পেরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদরের সম্মিলিত বাহিনী পলাশকান্দা গ্রামে মুজিব বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এসময় যুদ্ধরত অবস্থায় জসিম উদ্দিন হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে শহীদ হন। এ সময় হানাদারের হাতে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন আনোয়ারুল ইসলাম মনজু, মতিউর রহমান ও একেএম সিরাজুল হক। ধরাপড়া তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদার ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করার পর ব্রহ্মপুত্র নদীর চরে নিয়ে তাদের চোখ বেয়োনট দিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলে ফেলে, পরে হত্যা করা হয়।
রোববার বিকেলে বোকাইনগর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় শহীদ সিরাজের পাকা বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটি বসবাসের অনুপযোগী। সিরাজের ছোট ভাই এমদাদুল বাড়ির একটি রুম দেখিয়ে বলেন, সিরাজ ভাই এই কক্ষেই থাকতেন। এখন এখানে আর কেউ থাকে না। ভাইয়ের শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ১৭ দিন ছিলাম। ভেসে আসা কোনো লাশ দেখলেই মনে হতো এটা বুঝি ভাইয়ের লাশ। কিন্তু ভাইয়ের লাশ আর পাইনি। আর স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এসে ভাইয়ের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র পাইনি। মেলেনি সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা।
ময়মনসিংহ মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, সিরাজ ভাই সংস্কৃতিমনা ও সংগীতের ওস্তাদ ছিলেন। তিনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর ইউনিয়নের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সিরাজ সড়ক। তবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তার পরিবার কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়নি এই বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।