জীবন সংগ্রামে জয়ী আইরিন

, জাতীয়

কান্ট্রি ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-21 18:47:22

লক্ষ্মীপুর: নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাসহ অবহেলিত নারী সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল শৈশব থেকেই। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই বাবা মারা যান। তবুও জীবনের সাথে সংগ্রাম করে চালিয়ে গেছেন নিজের পড়ালেখা। শেষ করেছেন শহরের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর পড়াশোনা। নিজ উদ্যোগে জমানো অর্থ, পারিবারিক সহযোগিতা আর বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে খুলে বসেন আইরিন কম্পিউটার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তারপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অদম্য সাহস, সততা আর আপন কর্মের মাধ্যমে সফল হতে থাকেন তিনি। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেন স্থানীয়দের মাঝে। সফলতার খেতাব স্বরূপ চট্টগ্রাম বিভাগীয় সেরাসহ স্থানীয় পর্যায়ে পেয়েছেন বেশ কয়েকবার সম্মাননা ও অসংখ্য পুরস্কার। আর এ সফলতার পেছনে তার নিজের উদ্যোগই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়েছেন পরিবার, স্বামী, লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিদের কাছ থেকে।

বলছিলাম লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড বঞ্চানগর গ্রামের আলী আকবর ও সামছুন নাহারের মেয়ে আইরিন সুলতানার কথা। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি।

শিক্ষা জীবনে আইরিন লক্ষ্মীপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর লক্ষ্মীপুর শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটারের উপর ডিপ্লোমা ইন ইনঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর যুব উন্নয়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, স্থানীয় ও ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আউটসোর্সিং, অটোক্যাড, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইলেকট্রনিক্স, মাছ ও সবজি চাষ, বনায়ন, হাঁস-মুরগি পালনসহ প্রায় ২০টি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ঢাকার সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট ইলেকট্রিক্যালে বিএইচসি ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন আইরিন।

কর্মের শুরুতেই আইরিন এনজিও সংস্থা থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে একটি কম্পিউটার ক্রয় করে নিজের বাসায় মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। পাশাপাশি শুরু করেন বিভিন্ন হাতের কাজ। শহরের বিভিন্ন দোকানের অর্ডারকৃত জামা- নকশি কাঁথা সেলাই করতেন।

২০১১ সালে সদর উপজেলার চরশাহী ইউনিয়নের মো. শাহজাহান ভূঁইয়ার ছেলে মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখনও থেমে যাননি তিনি। স্বপ্ন পূরণের জন্য ও আত্মনির্ভরশীল নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর নিজের জমানো মূলধন দিয়ে শহরের ঝুমুরের মজু মার্কেটে ‘আইরিন কম্পিউটার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। প্রতিষ্ঠানটি মেয়েদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুরু করলেও বর্তমানে ছেলেমেয়ে উভয়কে আলাদা ভাবে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও কম্পিউটারের মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে থাকেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল নারীদের, গরীব-মেধাবীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন তিনি।

২০১৭ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আইরিন টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (৬৭০৩৬) নামে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড থেকে স্বল্পমেয়াদি বেসিক ৩৬০ ঘণ্টা অফিস এপ্লিকেশন, গ্রাফিক্স ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া, হার্ডওয়্যার অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং কোর্সের অনুমোদন পায়। এছাড়াও আউটসোর্সিংসহ আরও ৫টি ট্রেডে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন দক্ষতার সাথে। প্রতিষ্ঠানে আগত প্রশিক্ষণার্থীদের নিরাপত্তার জন্য একাধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছেন।

আইরিনের এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১২ সালে ৫০ জন, ২০১৩ সালে ৮০ জন, ২০১৪ সালে ১৮২ জন, ২০১৫ সালে ২২৭ জন, ২০১৬ সালে ২১৭ জন, ২০১৭ সালে ২৫০ জন ও ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ২০০ জনসহ মোট ১২০৬ জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন চাকরিসহ কর্মসংস্থান করে স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ১৪ জন, সহ-পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ৫ জন, গ্যাস অফিসে ১ জন, জেলা পরিষদের উদ্যোক্তা ২ জন, জেলা শিক্ষা অফিসে ১ জনসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শতাধিক নারী-পুরুষ। এছাড়া আবার কেউ কেউ নিজেই প্রতিষ্ঠান খুলে অন্যজনের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে।

সফলতার বিষয়ে আলাপকালে আইরিন সুলতানা বলেন,‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘চাকরি করবো না, চাকরি দিব’ সে কথাটিও নিজের মধ্যে লালন করি। তাই আজ সফল হতে পেরেছি। সফলতার পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছি বিভাগীয় সেরাসহ স্থানীয় বিভিন্ন সম্মাননা। সমাজের জন্য কাজ করলে সেরা হব, এটাই স্বাভাবিক। এখন স্বপ্ন অবহেলিত নারী সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং জাতীয় পর্যায়ে সেরা জয়িতা নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেওয়া। আর সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য এখনও কোনো সরকারি সহযোগিতা পাইনি। যদি এই সহযোগিতাটা পেতাম তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বহু নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম। এছাড়া আগে শিক্ষিত যুবসমাজ নিয়ে কাজ করলেও এখন সমাজের অসচ্ছল, নিরক্ষর, স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছি।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর