লিচু যৌবন ক্ষমতা

, জাতীয়

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-22 13:29:48

বাজারে এখন লিচু নেই বললেই চলে। লিচুর আয়ু ১৫ থেকে ২০ দিন; বেশি হলে মাস খানেক। লিচুর মতো এতো স্বল্পমেয়াদী ফল আর নেই। বাজারে আম আর লিচু প্রায় একই সময় আসলেও, লিচু এসেই চলে যায়। আবার অনেক ফল সারা বছরই পাওয়া যায়, অথবা সংরক্ষণ করে রাখা যায়। লিচু দুইদিনের বেশি রাখলেই এর খোসা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। কাজেই, যারা লিচুর কদর বোঝে, তারা এর মধ্যেই লিচু ভোগে মত্ত হয়। আম, আপেলসহ ছোটছোট ফলগুলো সাধারণত কেজি দরে বিক্রি হয়। লিচুর মতো এতো ছোটো একটি ফল বিক্রি হয় পিস হিসেবে। জাত বুঝে লিচুর দাম। দুই টাকা পিস (মানে একশ’ লিচু দুইশ’ টাকা) থেকে শুরু করে আট টাকা-দশ টাকাও হিসেবে বিক্রি হয়।

লিচুকে বলা হয় রোমান্টিক ফল। কিন্তু আম-বেদানা-আপেল-কমলা না হয়ে লিচু কেন রোমান্টিক ফল তা বোধগম্য নয়। কে কবে প্রথম লিচুর মর্যাদা অনুধাবন করেছিল তা জানা যায়না। তবে আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে ফল চাষের ওপর লেখা একটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে লিচু চাষ নিয়ে কথা আছে।

যতোদূর জানা যায়, যিশুখ্রীষ্টের জন্মেরও হাজার বছর আগে লিচুর আগমন। লিচুর আদি নিবাস চীনে। চীনের কাওয়াং তুং ও ফুকিং প্রদেশ লিচুর উত্‍পত্তিস্থল। চৈনিকরা লিচুকে বড় ভালবাসে। বিশ্বের অনেক রাজা-বাদশাহ তাদের রানী-বেগম-খাস বাদীদের মন জয় করতে লিচুর দারস্থ হয়েছেন। কথিত আছে, প্রাচীন চীনে থাং বংশের এক রাজা হুয়ান সাং তার বিশাল সৈন্যবাহিনীকে ৬০০ মাইল দূরে পাঠিয়েছিলেন লিচু সংগ্রহের জন্য! উদ্যেশ্য, তার বেগমকে লিচু উপহার দিয়ে তার হৃদয় জয় করা। চৈনিকদের বিশ্বাস, যারাই লিচু খাবে তারাই এ ফলের প্রেমে পড়বে!

আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় অনেক ভালো-ভালো জাতের লিচু চাষ হয়। কিন্তু কোনো জাতের লিচুই বাংলাদেশের নামে নেই। রাজশাহী, দিনাজপুর ও ইশ্বরদীতে ভালো লিচু হয়। কিন্তু আমরা ওইসব লিচুর নাম দিয়েছি বোম্বাই, মাদ্রাজি ইত্যাদি। চায়না-৩ লিচু সবচেয়ে ভালো।

চীনের ঝুয়াংয়ে অঞ্চলে প্রতি বছর লিচু আর কুকুরের মাংস খাওয়ার উৎসব হয়। আমাদের দেশে লিচু আলাদা করে উৎসব না হলেও ফল উৎসবে লিচু থাকতেই হবে। জাতীয় কবি ‘সিদেল চোর’, ‘ছিচকে চোর’, ‘গরু চোর’, ‘ব্যাংক চোর’ এমনকি ‘বাটপাড়’দের নিয়ে ছড়া-কবিতা না লিখলেও  ‘লিচু চোর’ নিয়ে ঠিকই ছড়া লিখেছেন। লিচুর গুণাগুনের শেষ নেই। তবে এর অন্যত গুণ হচ্ছে এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও ত্বকের সজীবতা বজায় রাখে। এক কথায় লিচু যৌবন ধরে রাখে এমন কথাও শোনা যায়। শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করছে, পাঁচটা ফলের নাম বলতো বলটু। বলটু: স্যার, আম, জাম, কাঠাল, আর দুইটা লিচু।

লিচুর মতোই আমাদের যৌবন। লিচু যেমন স্বল্পমেয়াদী, যৌবনের উপলব্ধিও তেমনি। মানুষের যৌবনকালের ব্যাপ্তি বেশি হলেও জীবন থেকে যৌবন বিদায় হলেই এর মর্যাদা বোঝা যায়। দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায়না, তেমনি যৌবন থাকতেও আমরা যৌবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারিনা। আমাদের জীবন থেকে লিচুর মতোই যৌবন চলে যায় পাগলা ঘোড়ার মতো।

কিন্তু আমরা যৌবনের মর্যাদা দিতে পারিনা। যখন যৌবন বিগত হয়, তখন হায় হায়! কথায় আছে, যৌবন যার সৎ, সুন্দর ও কর্মময় তার কাছে বৃদ্ধবয়স স্বর্ণযুগ। যৌবনের গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, শুধু রবীন্দ্রনাথের দুইটি লাইন, যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত/ আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে/রইবি কুণ্ঠিত? আজকের যৌবনের কাছে এটাই প্রশ্ন।

জ্ঞানীরা বলেন এই দুনিয়ায় সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা আসে আর যায়। শিশির যেমন সূর্য ওঠামাত্র শুকিয়ে যায়, শূন্যে লীন হয়ে যায়। ক্ষমতাও তেমনি। চিরকাল কাহারো সমান নাহি যায়। এই বঙ্গভূমিতে মুঘল, পাঠান, সেন, পাল, তুর্কি, ফরাসি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজরা শাসন করেছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। মুঘলরা সাড়ে তিনশ’ বছর, ইংরেজরা দুইশ’ বছর শাসন করেছে। পাকিস্তানীরা করেছে দুই যুগ-মানে ২৪ বছর।

তাদেরও বিদায় হতে হয়েছে। সুলতান সুলেমান, বাদশা আকবর, রানী ভিক্টোরিয়া সবাইকেই যেতে হয়েছে। এটাই ক্ষমতার আদিসূত্র। আইয়ুব খান, এরশাদ কেউ এই সূতের বাইরে না। কতো রাজা এলো-গেলো; ক’জন তাদের মনে রাখে। শুধু ইতিহাস পাঠে প্রাসঙ্গিক হলে হয়তো তাদের নাম চলে আসে। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। কাউকেই সেভাবে মনে রাখতে চায়না। যৌবন ও ক্ষমতার যারা সঠিক ব্যবহার করেছে, ইতিহাসে ও মানুষের কাছে তারাই স্মরণীয়। মৃত্যু মানুষকে মারতে পারেনা। মানুষের কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, কর্মই মানুষকে ধ্বংস করে। লিচু যৌবন ও ক্ষমতার মূল কথা-যথা সময়ে যথা কর্ম। এবং শুধুই কর্ম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর