শোলাকিয়ায় জঙ্গি হানা: ২ বছর পরও রক্তাক্ত স্মৃতি শঙ্কা জাগায়

, জাতীয়

মায়াবতী মৃন্ময়ী, অতিথি লেখক, বার্তা২৪.কম | 2023-08-22 13:42:15

 

কিশোরগঞ্জ থেকে: তারিখটি ছিল ৭ জুলাই। ২০১৬ সাল। দিনটি ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর। সকাল বেলা জঙ্গি হামলায় প্রকম্পিত হলো শান্ত কিশোরগঞ্জ শহর। মারা গেলেন পাঁচ জন। দেশের বৃহত্তম ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে সমবেত লাখ লাখ মানুষ স্তম্ভিত। শোলাকিয়ায় জঙ্গি হানার ২ বছরেও রক্তাক্ত স্মৃতি শঙ্কা জাগায় জনমনে।

২ বছর আগের সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে মানুষকে। ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রায় দুই শ’ বছরের ইতিহাসে এমন নাশকতার ঘটনা কোনদিন ঘটে নি। কিশোরগঞ্জের মানুষ এমন হামলার সম্মুখীন কখনো হয় নি।

২ বছর আগে ঈদ জামাতের প্রাক্কালে সংঘটিত রক্তাক্ত ঘটনার স্মৃতিচারণে সেদিনের জামাতের ইমাম মাওলানা শোয়াইব বিন আবদুর রউফ আজো বিহ্বল ও শিহরিত হন।

'জঙ্গি হামলার সময় কী করছিলেন তিনি', বার্তা২৪.কম-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেসব কথা বিস্তারিত জানিয়েছেন।

শোলাকিয়ায় সাধারণত ঈদের জামাত পড়ান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। নামাজের আগে শোয়াইব বিন আবদুর রউফ ৪০ মিনিট বয়ান বা আলোচনা করেন। সেদিন ছিল মাঠের ১৮৯তম জামাত। সে জামাতের পূর্বে বয়ানের মাঝখানেই তার ভাই গণমাধ্যমে খবর পেয়ে একবার মুঠোফোনে বলছিলেন, 'শোলাকিয়ায় গণ্ডগোল হচ্ছে।' কিন্তু তিনি গা করেননি। তিনি দেখেন, মাঠের পরিস্থিতি একদম স্বাভাবিক। তিনি বেশ আগে বক্তৃতা শুরু করেন, কিন্তু যখন দেখলেন নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও কেউ তাকে বক্তৃতা থামাতে বলছেন না, কিংবা ইমাম আসছেন না, তখন তার প্রথম সন্দেহ হয়। তিনি পেছনের দিকে তাকালে সেখান থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বক্তৃতা চালিয়ে যেতে ইশারা করেন।

হাফেজ মওলানা শোয়াইব আবদুর রউফ শোলাকিয়া মাঠে ঈদের দিনের ঘটনার বর্ণনাকালে জানান, শোলাকিয়া মাঠের নিয়োগপ্রাপ্ত দ্বিতীয় (বিকল্প বা প্যানেল) ইমাম আমি। শোলাকিয়ার মূল ইমামের অনুপস্থিতে আমি ঈদ জামাতের ইমামতি করি। বস্তুত আমি, কিশোরগঞ্জের বড়বাজার এলাকার শাহাবুদ্দীন মসজিদের ইমাম এবং স্থানীয় জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক।

বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, 'ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পেরে ও অন্যদের পরামর্শ অনুসারে নামাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা হয়। এরপর খুতবা ও দোয়াও একইভাবে সংক্ষিপ্ত করে শেষ করা হয়। কেননা, এ ঘটনার কোনো আঁচ যদি মাঠের কোনো অংশে পড়ত, তবে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।'

মাওলানা শোয়াইব আবদুর রউফ বলেন, 'পবিত্র কোরআনে সুরা মায়েদায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা। সুতরাং, ধর্মের নাম নিয়ে কেউ এই ধরনের হত্যাকাণ্ড চালালে তা কোনোভাবেই ধর্মসিদ্ধ নয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।'

তিনি বলেন, ‘সকাল নয়টা থেকে নয়টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত আমার বয়ান (বক্তৃতা) করার কথা। বয়ান শুরু করলাম আরও ১০ মিনিট আগে। কিন্তু নয়টা ৪৬ বেজে গেল, হুজুর (মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ) আসেননি, আমাকেও কেউ বয়ান থামাতে বলছে না। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমাকে ইশারা দেওয়া হলো, বয়ান চালিয়ে যান। এ সময় প্রথম সন্দেহ হয়, কোথাও কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।’

মাওলানা শোয়াইব আবদুর রউফ এভাবেই ১০টা পর্যন্ত বয়ান চালিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘আমি দেখছিলাম মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো তারা নামাজের জন্য প্রস্তুত। এমন অবস্থায় আমি বক্তৃতা শেষ করে পেছনের দিকটায় গেলাম। সেখানে ডিসি (জেলা প্রশাসক) সাহেবের সঙ্গে অন্যদের কথোপকথন থেকে বুঝলাম ঝামেলা হয়েছে। তখন সিদ্ধান্ত হলো যে যথাসময়েই নামাজ হবে।’

যখন শোয়াইব বিন আব্দুর রউফ বয়ান করছিলেন, তখন শোলাকিয়া মাঠের আধা কিলোমিটারের মধ্যে আজিমউদ্দীন হাইস্কুলের কাছে সবুজবাগে পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলি চলছিল। মাঠে অনেকেই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন। অনেকে পরিবার-পরিজনের ফোনে বিষয়টি জানতে পারেন। কিন্তু আবদুর রউফ ছিলেন অন্ধকারে। নামাজ শুরু হওয়ার মিনিট ১৫ আগে কোনো একটা সমস্যার আঁচ পান তিনি। তবে সেটা যে এতো ভয়াবহ ছিল, বুঝতে পারেন নি তিনি।

দীর্ঘক্ষণ ধরে হামলা চলেছিল সে দিন', বার্তা২৪.কমকে বলেন স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ ভৌমিক। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অনেক বাড়ির দেয়ালে গুলির চিহ্ণ ও ক্ষত দেখা যায়। যে জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর গুলি ঢুকে প্রাণ হারান ঝর্ণা রাণী ভৌমিক, সেখানে তার ছবিসহ স্মৃতিস্মারক বানানো হয়েছে। সামনের সড়কটির নামকরণও করা হয়েছে তার নামে।

শোলাকিয়া মাঠের কাছে বিস্ফোরণের পর ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ মাঠে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি শহরের পুরাতন স্টেডিয়ামে হেলিকপ্টার থেকে নামেন। সেখান থেকে মাঠে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও তাকে সার্কিট হাউসে যেতে হয়। এর মধ্যে ঈদের নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় বিকল্প ইমাম শোয়াইব বিন আবদুর রউফ
নামাজ পড়ান।

শহরের পূর্বপ্রান্তের প্রায়-গ্রামীণ এই আবাসিক এলাকায় এমন সন্ত্রাসী ঘটনার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি। পুরোটা সময় এলাকাবাসী আতঙ্কের গর্ভে নিমজ্জিত ছিল। সিনিয়ার সাংবাদিক নূর মোহাম্মদ ছিলেন সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, 'লাখ লাখ মুসুল্লী শোলাকিয়া মাঠে অপেক্ষা করছিলেন। তখন সকাল ৮.৪০ মিনিট। এমন সময় জঙ্গি হামলা হয় মাঠে আসার পথে সবুজবাগ এলাকায়। পুলিশের সাহসিক আত্মত্যাগে জঙ্গিরা পরাস্ত হয় এবং নির্বিঘ্নে ঈদের জামাত সম্পন্ন হয়। পুলিশসহ সেদিন মোট পাঁচ জন নিহত হন।'

এ জঙ্গি হামলার ঘটনার পরের বছরগুলোতে শোলাকিয়ার ঈদ জামাতের প্রাক্কালে নিরাপত্তার প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্ব পায় সর্বমহলে। দেশের বৃহত্তম ঈদগাহের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে শান্তি ও নিরাপত্তার দিকে প্রশাসন মনোযোগী হয়। নেওয়া হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় এবং ঈদের দিন শোলাকিয়ার আকাশে উড়ে ড্রোন, যাতে সংস্থাপিত ক্যামেরা দিয়ে পুরো নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়


২০১৬ সালের ঘটনার পর নিহত ঝর্ণা রাণী ভৌমিকের এক ছেলেকে চাকরি দেয়া হয় সরকারের উদ্যোগে। এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবার বার্তা২৪.কমকে বলেন, '২ বছরেও জঙ্গি হামলা ঘটনারটির বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা চাই অতিদ্রুত এই সন্ত্রাসী ঘটনার বিচার হোক।' জানা গেছে, জঙ্গি হামলার ২ বছরেও চার্জশিট তৈরি হয় নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর