নির্বাচন কমিশনে (ইসি) স্বেচ্ছাচারিতা ও মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন চার কমিশনার। এর সুরাহা না হলে দায়িত্ব ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন কোনো কোনো কমিশনার। এমনকি তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও তোলেন।
জানা গেছে, বুধবার বিকাল ৩টায় সিইসির সভাপতিত্বে ৫৬তম কমিশন সভা শুরু হয়ে চলে সোয়া ৫টা পর্যন্ত। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে বৈঠক। বৈঠকের এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বক্তব্য দেন চার কমিশনার যথা- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, কবিতা খানম, মো. রফিকুল ইসলাম ও মাহবুব তালুকদার। বক্তব্যে কমিশন সচিবালয় কমিশনারগণকে অপমান ও চ্যালেঞ্জ করেছে এমন অভিযোগ তোলেন তারা। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক কর্মচারী নিয়োগ ইস্যুতে এবার আনুষ্ঠানিক সভায় কড়া বক্তব্য দেন চার কমিশনার। তাদের এসব বক্তব্যের সময় চুপ ছিলেন সিইসি। পরে বক্তব্য শেষে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হলে সিইসি কমিশনারদের উদ্দেশে বলেন, এসব বিষয় নিয়ে আমরা (কমিশনাররা) নিজেরা আলাপ করবো। এখন এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা করুন। পরে কমিশন সভার এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের (নির্বাচন কমিশনারদের) কিছু বক্তব্য কমিশন সভায় তুলে ধরেছি। আমরা কমিশনাররা পরে আবার বসবো।
আর জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে সভায় ইসি সচিবালয়ের চিঠি প্রসঙ্গে আরেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, উত্তরপত্রটিতে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি কমিশনারদের মুখোমুখি করার একটা প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি বলেন, কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের অনুস্বাক্ষরসহ অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় যে উত্তর দেয়া হয়েছে তা সকল কমিশনারকে হতবাক করেছে। কেননা উল্লেখিত পত্রে কমিশনারদের প্রদত্ত ইউওনোটকে (আনঅফিসিয়াল নোট) সম্পূর্ণরূপে পাশ কেটে অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে।
নিয়োগ প্রসঙ্গে এ কমিশনার বলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করার বিষয়টি আড়াল করে নির্বাচন কমিশনারদের হেয় করার প্রয়াস মাত্র- যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হলে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সকল কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
শেষ বক্তব্যে এ কমিশনার বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমিশনের সভাপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি সব সময় সংবিধানসহ বিদ্যমান সকল আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে এটাই কাম্য। সিইসি সকল নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিদ্যমান সকল আইন অনুসরণ করে কমিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এমন প্রত্যাশা করেন এ কমিশনার। একইভাবে আরও দুই কমিশনার সচিবালয়ের কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
এদিকে কমিশনারদের বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। তিনি বলেন, বৈঠকের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার কোন সুযোগ নেই। এটা একেবারেই গোপনীয় বিষয়, ইন্টারনাল বিষয়। কমিশনে বিভেদ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাজ করতে গেলে অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে, আপনারা যদি এটাকে ইসির মধ্যে বিভক্তি হয়েছে বলতে চান তাহলে বলবো এ ধরনের কিছু হয়নি। কমিশনের সব কাজ সুষ্ঠুভাবে চলছে। বলতে পারেন মতপার্থক্য আছে কিন্তু বিভক্তি নেই।
সিইসি ও কমিশনারদের মধ্যকার দূরত্বে সচিব হিসেবে বিব্রত কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর বলেন, সচিব হিসেবে বিব্রত হওয়ার সুযোগ নেই। আইন কানুন, রুলস রেগুলেশন অনুযায়ী আমি ও আমার কর্মকর্তারা কাজ করি। এখানে বিব্রত বা দ্বন্দ্বের সুযোগ নেই। সভায় কমিশনারদের কেউ কেউ দায়িত্ব ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, এটা কমিশন সভার ইন্টারনাল ও গোপনীয় বিষয়। এটা নিয়ে কিছু বলা যাবে না।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সভায় একজন কমিশনার তার বক্তব্যে বলেন, নিয়োগ নিয়ে আমার এক ইউওনোটের (আনঅফিসিয়াল নোট) উত্তরে কমিশন সচিবালয় থেকে যে উত্তর দেয়া হয়েছে তা নির্বাচন কমিশনারগণের চরিত্র হননের অপচেষ্টা মাত্র। গত ৯ ডিসেম্বরের চিঠিতে আমাদের জানানো হয়েছে, মাননীয় নির্বাচন কমিশনারদের সুপারিশকৃত কয়েকজন পরীক্ষার্থী মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণকালে প্রক্সি পরীক্ষার্থী হিসেবে ধরা পড়েন। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে একান্ত সচিবগণকে মৌখিকভাবে জানানো হয়। উক্ত পরীক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয় এবং মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো হয়।
এ প্রসঙ্গে ওই কমিশনার সভায় বলেন, চিঠির এ উত্তর নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি অপমানজনক। ইসির একজন যুগ্ম সচিবের অনুরোধে আমি যুগ্ম সচিবকে (প্রশাসন) একটি রোল নম্বর প্রদান করেছিলাম। সিকিউরিটি গার্ড পদের ওই প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়নি, কোনো পর্যায়ে বহিষ্কার করা হয়নি। নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় পাস করায় তাকে ভাইভায় ডাকা হয় এবং প্রার্থী ভাইভা পরীক্ষা দেন। তাকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো হয়। এ বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে আমার একান্ত সচিবকে জানানো হয়েছে বলে সচিবালয়ের চিঠিতে যে দাবি করা হয়েছে তা মিথ্যাচার মাত্র।
ওই কমিশনার আরও বলেন, চিঠিতে নির্বাচন কমিশনারদের সুপারিশকৃত প্রার্থীরা নির্বাচিত না হওয়ায় তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- সচিবালয়ের এই বক্তব্য নির্বাচন কমিশনারদের অপমান করা এবং নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ ও চ্যালেঞ্জ করার সামিল।
ওই কমিশনার বলেন, এক বছরের অধিককাল আগের এক নির্দেশ যথাযথভাবে পরিপালিত না হওয়ায় যৌক্তিকভাবেই আমি কমিশন সচিবালয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে বলে উল্লেখ করেছি। কিন্তু গত ২৫ নভেম্বর সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কমিশনের অনুমোদন ব্যতিরেকে কোন কর্তৃত্ববলে প্রেস কনফারেন্স করে নির্বাচন কমিশনারদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে জাহির করলেন তা বোধগম্য নয়।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় জানিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বৈঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও কমিশন সচিবালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে সচিবালয়ের বর্তমান স্বেচ্ছাচারিতা ও মিথ্যাচারের বিহিত না হলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন প্রায় অসম্ভব।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ৩৩৯জন কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চেয়ে চারজন নির্বাচন কমিশনার সিইসি বরাবর ইউওনোট দেন। ওই ইউওনোটে তারা কমিশনের এখতিয়ার ও কর্তৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। পরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিং করেন। ওই ব্রিফিংয়ের পরই ইসির সিনিয়র সচিবও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো অনিয়ম হয়নি। এবং নিয়োগ কার্যক্রম কমিশনারের এখতিয়ারভুক্ত নয়। পরে ইউওনোটের জবাব গত ৯ ডিসেম্বর কমিশনারদের দেয়া হয়। ওই জবাবে কমিশনের একজন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেন। এ বিষয়টি নিয়ে বুধবার কমিশন সভায় ক্ষুব্ধ বক্তব্য রাখেন চার কমিশনার।