১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাত। ‘পূর্ব বাংলা' নামে পাকিস্তানের প্রদেশটি মাত্র স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। ঠিক সে সময় ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরের চিহ্নিত জ্ঞানী ও গুনী মানুষদের বাড়ির দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করে জানতে চাওয়া হয় "ভেতরে কেউ আছেন?" ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসেন নাম জানা-অজানা অনেকেই। সশস্ত্র পাকিস্তানি হায়েনারা একে একে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায় ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
সেদিন হায়েনাদের সাথে বেরিয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত তারা আর ঘরে ফেরেনি। সবকটি জানালা খুলে রেখেও হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য স্বজনদের ফেরার অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি। তবে তারা আসবেন কিভাবে? তারা যে এ মাটির চির মমতা অঙ্গে মেখে অনিচ্ছাকৃত চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর বধ্যভূমির মতো চিহ্নিত কসাইখানায়।
স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবছর দেশ ও জাতি ১৪ ডিসেম্বর হারিয়ে যাওয়া বীরদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেন রায়েরবাজার বধ্যভূমি তথা শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। এদিন সকাল থেকে নিহতের স্বজনসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অঙ্গ সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বস্তরের মানুষ শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এক নদী রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরে এসেও তাদের নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এসব নিয়ে আজকের দিনেও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করতে শোনা গেছে স্বজনদের।
এ ব্যাপারে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার বলেন, বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা করতে হবে। সেই সাথে রাজাকারদের তালিকাও করতে হবে। আমরা যারা সত্যিকার স্বাধীনতার পক্ষের প্রজন্ম তাদেরকে সংঘবদ্ধ হতে হবে এবং স্বাধীনতা বিরোধী সকল ধরনের অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, আগামী বছর ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ লক্ষ্যে ৩০০ জনের একটি খসড়া তালিকা করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কিছু সমস্যা থাকার কারণে খুব দ্রুত এই তালিকাটি সম্পন্ন করা যাচ্ছে না।
শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন রায়ের বাজার হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার রুদ্র। রুদ্রর সাথে কথা বলে জানা যায়, স্কুলের শিক্ষক ও বাবা-মার কাছ থেকে ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। দেশের জন্য অকাতরে এভাবে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া শহীদদের জন্য তার খারাপ লাগে। তাই এত সকালে স্কুলের সহপাঠীদের সাথে বধ্যভূমিতে এসেছেন ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দিনব্যাপী শ্রদ্ধা নিবেদনসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। পথনাটক, কাব্যনাট্য, কবিতা আবৃত্তি ও দেশাত্মবোধক গানসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান তুলে ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হায়েনাদের মাধ্যমে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী হত্যার এই ঘৃণ্য প্রয়াস তখন থেকে আজ অব্দি বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ঘৃণাভরে স্মরণ করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার যে ঘৃণ্য প্রয়াস তা কোনোভাবেই শব্দ বর্ণ অক্ষর বা মাত্রাবৃত্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না বলে মনে করেন রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা দেশপ্রেমী প্রজন্ম।
অনেকেই বলছেন, সেদিনের এই হত্যাকাণ্ড এই দেশের প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা তাদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঠাঁই মানুষের হৃদয়ে, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। জাতি সব সময় তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।