'দেশে গেলি ফিঙ্গার মাইরে দিবে'

ঢাকা, জাতীয়

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 22:49:28

আল জুবায়ের (শারজা) থেকে: ভাগ্যের অন্বেষণে ২০০৯ সালের গোঁড়ার দিকে দুবাই আসেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার লোকমান হোসেন। আসার কিছুদিন পরেই তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। হয়ে যান অবৈধ শ্রমিক, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে 'খাল্লিবাল্লি'। এখন কোনো কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ নেই লোকমান হোসেনের। তাই কিছুদিন আগে হাবিব নামের এক বাঙালির সঙ্গে শারজার আল জুবায়ের গ্রামে এক খণ্ড জমি বন্ধক নেন। প্রায় ৬ বিঘা আয়তনের এই জমিতে চাষ শুরু করেন নানা জাতের সবজি। স্থানীয় ভাষায় সবজি চাষকে বলা হয় 'জরিপা'। তার বন্ধকী জমিতে প্রায় ১১ জাতের শাক উৎপাদন করা হয়।

শীত এবং গরম দুই ঋতুতেই ভিন্ন ভিন্ন জাতের সবজি চাষ হয়। স্থানীয়দের পছন্দের তালিকায় রয়েছে জর্জিশাক, রায়হানশাক, শ্যাপত, বাগধানুস শাক। আরবীয়রা এসব শাক কাঁচা খেয়ে থাকেন। আর বাঙালিদের জন্য মুলা শাক, লালশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, ধনিয়াপাতা এসব চাষ করা হয়।

শারজার আল জুবায়ের এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল্লাহর মাসিক সাড়ে ৩ হাজার দিরহাম এবং বিদ্যুৎ খরচ বাবদ ৫০০ দিরহাম মোট ৪ হাজার দিরহাম খরচ হয়। আর বীজ, সার ও শ্রমিক খরচ বাবদ আরো দুই হাজার দিরহাম খরচ হয়।

লোকমান হোসেনের সবজি ক্ষেত

লোকমান হোসেনের ভাষায় খরচ বাদ দিয়ে কোনো মাসে ৮ হাজার আবার কোনো মাসে ১০ হাজার দিরহাম থাকে। তার আরো দুই জন পার্টনার রয়েছেন। তারা হলেন মহিউদ্দিন ও রুবেল। মাসে খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে এই তিনজন সমান ভাগে ভাগ করে নেন। এটা গেল তাদের আয়ের হিসেব।

এদিকে লোকামন হোসেনের ক্ষেতের পাশেই রাতের বেলায় চলে সবজি প্রসেসিং। খেত থেকে সবজি তুলে সারারাত ধরে প্রসেসিং করা হয়। ছোট্ট ছোট্ট মুঠা বা আঁটি বেঁধে শারজার বিভিন্ন বাজারে নেওয়া হয় শাকগুলো। যার প্রতি আঁটির দাম ১ দিরহাম যা বাংলাদেশী টাকায় (২৩ টাকা ২০ পয়সা)। দিরহামের মূল্যের উপর টাকার হার ওঠা নামা করে। আবার এখানে যারা কাজ করছেন তার অধিকাংশই অবৈধ শ্রমিক।

লোকমান হোসেনের ক্ষেতের পাশেই রাতের বেলায় চলছে সবজি প্রসেসিং

এখন আসা যাক তাদের দুর্দশার কথায়। কেন তারা 'খাল্লিবাল্লি'? দুবাই সরকার ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনার অনুমতি বন্ধ করে দেয়। যাকে বলা হয় কলিং বন্ধ। এরপর যারা আসছেন তাদের কেউ ভিজিট ভিসায় এসে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আবার কেউ এভাবে দুর্গম এলাকায় জমি চাষ করছেন।

যারা জমি চাষ করছেন তাদের বলা হয় জরিপার কাজ। শারজায় প্রায় ৪ হাজার জরিপা রয়েছে। তাতে প্রায় কয়েক লাখ শ্রমিক রয়েছেন। এদের অধিকাংশই অবৈধ শ্রমিক। এসব শ্রমিক যেতে পারেন না স্থানীয় মার্কেট বা শপিং মলে, তাদের জমিতেই থাকতে হয়। কেননা যদি পথে ধরা পড়েন তাহলে তাদের জেল খাটতে হবে। তাই দুর্গম এলাকাতে থাকেন, সেখানেই কাজ করেন। আর দেশে যান না কারণ একবার গেলে আর আসতে পারবেন না।

লোকমান হোসেন এর সবজি ক্ষেতে তার সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কমের। তিনি বলেন, 'আমি আছি প্রায় ১১ বছর। এই ১১ বছর দেশে যাবার পারি না। গেলিই তো ফিঙ্গার মাইরে দিবে। আর আসতি পারব না।'

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার লোকমান হোসেন

'ভিসা খুললেই ভিসা লাগাতে পারি। কবে খুলবে আর কবে লাগাব। আমরা যারা খাল্লিবাল্লি আছি তারা এই জমিতেই থাকি। মার্কেটে যাবার পারি না। পথে ধরলি তো পতেকা (আইডি কার্ড) দেখাবার চাইবি। তখন তো দেখাতি পারব না। বিপদ হবি। তাই বাইরে যাই নে। ক্ষেতেই থাকি।'

লোকমান হোসেন বলেন, ভিসা লাগাতে পারলে তো ব্যবসা করতে পারতাম ঠিকমতো। মার্কেটে যেতে পারব। তাই ভিসা লাগলেই সব খুলে যাবে।

শুধু লোকমান নয় এখানে কয়েক লাখ অবৈধ শ্রমিক রয়েছেন। তারা স্থানীয় আরবীয়দের সহযোগিতায় জমি চাষ করছেন। স্থানীয়দেরও সুবিধা হচ্ছে। কেননা যে জমিতে তারা চাষ করছেন ওই জমি ছিল ধু ধু বালু, যেটা পতিত পড়ে থাকত। বাঙালিরা এসেই জমি চাষ করছেন তাতে স্থানীয়রা মাসিক হারে দিরহাম গুণে নিচ্ছেন। তাই অবৈধ সত্ত্বেও তারা মেনে নিচ্ছেন নিজেদের সুবিধার্থে।

আর এই অবৈধ শ্রমিকের কারণে বাংলাদেশ সরকার তার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চলতি বছরের রেমিটেন্সে যে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, অবৈধ শ্রমিকদের কেউ বৈধপথে টাকা পাঠান না। কেননা বৈধপথে টাকা দিতে গেলেই চাইবে আইডি, দেখাতে না পারলে যেতে হবে কারাগারে। তাই জেনে শুনেই অবৈধভাবে রয়েছেন অনেকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর