অবৈধ ইটভাটায় বরিশালে বায়ু দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে

বরিশাল, জাতীয়

জহির রায়হান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল | 2023-08-29 22:31:35

বরিশালে যত্রতত্র বেড়ে চলছে ইটভাটার সংখ্যা। সড়ক পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকার নদীর চর ও তীরে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই ইটভাটাগুলো অবৈধভাবে গড়ে তুলছে মৌসুমি ইট ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বাসা-বাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে বিধি-নিষেধ না মেনেই অবৈধভাবে ইটভাটাগুলো গড়ে উঠছে।

ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে অবাধে গাছ কেটে পোড়ানো হচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।

বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৪৭৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৪৭টি ইটভাটা। বাকি ১২৯টি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। আর আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৩৯০টি এবং সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি-(৮০-১২০ ফিট) ইটভাটা রয়েছে ৮৬টি।

কাঁচা ইট তৈরি করছেন শ্রমিকরা/ ছবি: বার্তা২৪.কম

বরিশাল জেলায় ১৭৮টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ১০৮টি, ছাড়পত্র পায়নি ৭০টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ১৪৪টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ৩৪টি।

পটুয়াখালী জেলায় ৭৩ টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৫২টি,ছাড়পত্র পায়নি ২১টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৫৬টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ১৭টি।

বরগুনা জেলায় ৫৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৫২টি,ছাড়পত্র পায়নি ৪ টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৫৪টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২টি।

ভোলা জেলায় ৮৮টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৬৭টি, ছাড়পত্র পায়নি ২১ টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৮৩টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২টি। তবে শুধু ভোলায় ৩টি হাইব্রিড হফম্যান কিলন অটো ব্রিকস রয়েছে।

বরিশালে গড়ে উঠছে অবৈধ ইটভাটা / ছবি: বার্তা২৪.কম

ঝালকাঠী জেলায় ৩৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৪টি, ছাড়পত্র পায়নি ৫ টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ১৯টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ২০টি।

পিরোজপুর জেলায় ৪২টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৪টি, ছাড়পত্র পায়নি ৮টি। এর মধ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা রয়েছে ৩১টি, সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি ইটভাটা রয়েছে ১১টি।

এ ছাড়াও বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় আরও দেড় থেকে দুইশত অবৈধ ইটভাটা রয়েছে বলে দাবি করছেন একাধিক ইটভাটা ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ইট তৈরির মৌসুমে (ডিসেম্বর-এপ্রিল) বরিশাল বিভাগে অবৈধ ইটভাটায় ৬২টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ইটভাটার মালিক ও ম্যানেজারসহ ৫২ জনকে আসামি করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। একই সাথে অবৈধ ৪০টি ড্রাম চিমনি ভেঙ্গে দেয়া সহ ৮০টি ইটভাটার আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ২ কোটি কাঁচা ইট ধ্বংস করা হয়।

ধ্বংস করা হচ্ছে কাঁচা ইট/ ছবি: বার্তা২৪.কম

চলতি বছর ৬টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযানে ৬টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ইটভাটার মালিক ও ভাটার ম্যানেজারসহ ৫৩ জনকে আসামি এবং ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই ভাটার প্রায় ২৭ লাখ কাঁচা ইট ধ্বংস করা হয়।

মেসার্স মক্কা ব্রিকস’র স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, অবৈধ ইটভাটার ফলে বৈধ ইটভাটার মালিকরা লোকসানের দিকে যাচ্ছে। অবৈধ ইটভাটার মালিকরা বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ ইটভাটা তৈরি করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আখতার ফারুক শাহিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, ইটভাটার মালিকরা পুরোপুরি নিয়ম বিধি-বিধান আর পরিবেশের আইন না মেনেই নিজের ইচ্ছে মত জায়গায় এসব ইটভাটাগুলো তৈরি করছে। বেশি লাভবান হওয়ার জন্য কম টাকায় কাঠ, গাছ ও টায়ার দিয়ে নতুন ইট পুড়ছে। ফলে ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ু দূষণ করছে।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের যোগসাজশে ইটভাটার মালিকরা ব্যবসা করেই যাচ্ছে। সরকারযন্ত্র কঠোর না হলে এসব ভাটাগুলোর সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়বে এবং পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবে।

ধ্বংস করা হচ্ছে কাঁচা ইট/ ছবি: বার্তা২৪.কম

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক আঞ্জুমান আরা রজনী বার্তা২৪.কম-কে জানান, ইটভাটাগুলো বায়ু দূষণের পাশাপাশি কৃষিজমি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করছে। মাটির উপরিভাগেই বেশি কৃষির উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। কিন্তু ইটভাটাগুলো সেই মাটির উপরিভাগ কেটে নিয়েই ইট তৈরি করছে। ফলে দিনে দিনে কৃষির জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনৈতিকভাবেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক মো. আবদুল হালিম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের চোখ আড়াল করে ইট উৎপাদনের মৌসুমে মৌসুমি ইটভাটা ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে গড়ে তুলছে ড্রাম চিমনি ইটভাটা।

কম বিনিয়োগে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য সহজেই নদীর চরের মাটি কেটে ইট তৈরি করছে তারা। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানোর ফলে দিন দিন বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি ফসলি উর্বর জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য অশনিসংকেত।

অবৈধ কারখানার চিমনিগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে/ ছবি:বার্তা২৪.কম 

এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তর। নিয়মিত অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভাটায় থাকা কাঁচা ইট পানিতে ভিজিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরির নতুন আইন বাস্তবায়নের জন্য ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও অবৈধ ইটভাটার মালিকদের বার বার নোটিশ দেয়া হচ্ছে, আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা ব্যবহারের জন্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর