রাজশাহীর চারঘাটের বীরাঙ্গনা সন্যাসী রাণী আর নেই। শনিবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি পরলোকগমন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন।
সন্ধ্যায় চারঘাট কেন্দ্রীয় শ্মশানে সন্যাসী রাণীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রায়হানুল হক, সাবেক পৌর মেয়র নার্গিস খাতুন, চারঘাট সোয়ালোজের পরিচালক মাহমুদা বেগম গিনি প্রমুখ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে যেসকল বাঙালি নারী নির্যাতিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তাদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। চারঘাটের সন্যাসী রাণী ছিলেন তাদেরই একজন। কিন্তু সরকারিভাবে তিনি স্বীকৃতি পাননি।
পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে চারঘাট উপজেলা সদরে মধ্যবিত্ত বনেদী পরিবারে সন্যাসীর জন্ম হয়। তার পিতা কিশোরী চন্দ্র সাহা এবং মা গংগা রাণী সাহা। দুই ভাই বোনের মধ্যে সন্যাসী রাণী ছোট। ৬০-এর দশকে বাবা মা ঘটা করে সন্যাসীর বিয়ে দেন স্থানীয় যতীন চন্দ্র সাহার সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের মাত্র তিন বছরের মধ্যে এক সন্তান রেখে স্বামী মারা যান।
সন্যাসীর সিঁথির সিঁদুর উঠে যায়। তিনি হয়ে পড়েন বিধবা। হিন্দু ধর্মের কঠোর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তার আর বিয়ে করা হয়নি। একমাত্র সন্তান নারায়ণকে অবলম্বন করে তিনি বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। আসে ১৯৭১ সাল। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী অতর্কিত ভাবে চারঘাট আক্রমণ করে।
পাক বাহিনীর অবিরাম গুলি বর্ষণে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক ব্যক্তি শহীদ হন। তাদের মধ্যে সন্যাসীর বাবাও ছিলেন। এলাকার অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হলে অধিকাংশ মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেন। কিন্তু সন্যাসী রাণী বাবাকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে চারঘাটের মাটিতেই থেকে যান।
চারঘাটের বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এদেশীয় দালালরা সারদা পুলিশ একাডেমি ক্যাম্পে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেয় সন্যাসী রাণীকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ নয় মাস নরপিশাচরা সন্যাসীর ওপর চালায় নিপীড়ন। দেশ যখন স্বাধীন হয় সন্যাসী তখন অন্তঃসত্ত্বা। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সন্যাসী এক সন্তানের জন্ম দেন। সন্তান দু’টির হদিস তার জানা নেই।
সংসারে আপন বলতে তার কেউ ছিল না তার। অসুস্থ হয়ে কংকালসার হয়ে গিয়েছিল তার দেহ। খাবার নেই, পরনের কাপড় নেই। নিজের কোন জায়গা জমি বাড়ি ঘর নেই। মানুষের করুণা ভিক্ষা করে তিনি বেঁচে ছিলেন। সম্বল বলতে সরকারের দেওয়া বয়স্ক ভাতা ছিল। কেউ তাকে ভালোবাসতো আবার কেউ তাকে ‘পাগলী’ বলে নিষ্ঠুর রসিকতা করতো।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ সন্যাসী রাণী সবাইকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। সকাল থেকে রাত অবধি চারঘাট বাজারের পথে পথে আপন মনে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। উপজেলা সদরে থানা রোডের পাশে একটি খুপরি ঘরে জীবনের শেষ বেলায় এসে একাকী থাকতেন বীরাঙ্গনা সন্যাসী রাণী।