সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন বছরে শেখ হাসিনার সরকার

ঢাকা, জাতীয়

লুৎফে আলি মহব্বত, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 16:22:57

একের পর এক চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ১১ বছর অতিক্রম করে ২০২০ সালে প্রবেশ করেছে। বিগত বছরগুলোতে যুদ্ধাপরাধের বিচার, জঙ্গিবাদ নির্মূল, সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তার রোধ ইত্যাদি জাতীয় ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দলে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং বিতর্কিত, অনুপ্রবেশকারী, পথভ্রষ্টদের হটিয়ে দেওয়ার অতি জরুরি কাজও করতে হয়েছে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন রোধ, সড়কে নিরাপত্তা আনা, ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে সরকারকে। এসব সাফল্যের পাশাপাশি চলমান চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হয়েছে সরকারের নতুন বছর ২০২০ সাল।

১/১১-এর ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। চারিদিকে তখন অগ্নি সন্ত্রাস, সীমাহীন নৈরাজ্য, জ্বালাও-পোড়াও, জঙ্গি ও যুদ্ধাপরাধীদের হুঙ্কার, মাদকের ছোবল আর অস্ত্র ও সন্ত্রাসের ঝনঝন শব্দ। শাসন ও প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান অচলাবস্থাকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে সরকারকে। ফিরিয়ে আনতে হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক ও নিরাপদ সামাজিক জীবন এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা।

তারপরও মাঝে মাঝে মাথা তুলেছে জঙ্গিবাদ, বন্যার মতো মাদকের ঢল নেমেছে। সেগুলোকেও সামাল দিতে সর্বক্ষণ কাজ করতে হয়েছে। প্রায়শই অত্যন্ত স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটেছে নারী নির্যাতন, শিক্ষাঙ্গনে হত্যা, সড়কে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। ফেনির নুসরাত ও বুয়েটের আবরার হত্যা, সড়কে যন্ত্রদানবের কবলে নিহত শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ ও জনরোষ থামাতে হয়েছে সরকারকে।

ফলে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি অগ্রাধিকারের বিষয়কে। এর মধ্যে রয়েছে, মাদক-অস্ত্র-জঙ্গিবাদ রোধ, নারীর প্রতি সহিংসতা দমিয়ে আইন-শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ বিধান, দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন নিশ্চিত করা, সড়কে, সমাজে, শিক্ষাঙ্গনে শান্তি বজায় রাখা, দারিদ্র্য কমানো ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিকল্পিত নগরায়ন কাঠামো তৈরি করা।

বস্তুতপক্ষে, চ্যালেঞ্জগুলো চলমান এবং একদিনে মোকাবেলার মতো নয়। বছরের পর বছর পরিকল্পনা ধরে ক্রমে ক্রমে এগিয়েই এসবকে চিরউচ্ছেদ করা সম্ভব। এরই মাঝে সরকার ২০০৯-২০১৯ সালের সময় সীমায় আর্থ, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং যেসবের স্পষ্ট সাফল্যও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের বড় সাফল্য হলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা, যা ১৯৯৬-৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন। ২০১৯-২০ সময়কালে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা সামাজিক উন্নয়নে বরাদ্দ হওয়ায় ৮৭ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ভাতা পাচ্ছেন। তাদের ডাটাবেইজ তৈরি করে সরাসরি ব্যাঙ্ক একাউন্টে টাকা পাঠানোর সহজ ও বিড়ম্বনাহীন ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। ২০১৯ সালেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ১৪৫টি প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে।

একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্পের অধীনে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১ লাখ ৫ হাজার ৭২৩টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠনের মাধ্যমে ৪৭ লাখ অবহেলিত পরিবারকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাঙ্কের ১০০টি শাখা উদ্বোধন করে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩ লক্ষ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১০৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা উণ সহায়তা দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করা হয়েছে। প্রায় ৩ কোটি মানুষকে ১০ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহ করা হয়েছে।

জাতীয় যুব নীতি গ্রহণ করে ৩৬৩১ টি যুব সংগঠনকে নিবন্ধন করা হয়েছে। দক্ষ মানব সম্পদ বাড়াতে ২৭ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৪ জন যুবককে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থান বাড়াতে প্রায় আড়াই লাখ যুবককে সোয়া ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। সরকার ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজনের পাশাপাশি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে।

২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে কাজ করে সরকার জাতীয় প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৮.১৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। মাথাপিছু আয় হয়েছে দুই হাজার ডলার। রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

স্বাস্থ্যসেবা বিকাশের লক্ষ্যে সরকার ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি ৪৫ প্রকার ঔষধ বিনামূল্যে গরিব মানুষকে সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। ২৩ হাজারেরও বেশি চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও ১৪ হাজার নার্স নিযুক্ত হয়েছেন। ৫৯টি সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রসারে ৩শ’ ৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সুরক্ষায় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশীয় চাহিদার ৯৮% শতাংশ ঔষধ দেশে উৎপন্ন হচ্ছে এবং মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর ১০ মাস।

কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছেন। দেশে বছরে ৪ কোটি ৪৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। ৪০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কৃষি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে বিগত ১১ বছরে। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের ভিত্তিতে ৩টি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ৫৮৪টি উচ্চফলনশীল জাত ও ৪৪২টি উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। মাত্র ১০ টাকায় ব্যাঙ্ক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়ায় কৃষকদের ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা সম্ভব হয়েছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থান এবং মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।

শিল্পায়নেও বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। পোশাক শিল্পে প্রণোদনা ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করা হয়েছে। নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে এক্ষেত্রে। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৭টি মামলায় ১০৩জন আসামির সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৪জন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ ও নিজ নিজ ধর্ম পালনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকার আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। মসজিদ, মন্দির ভিত্তিক শিক্ষা প্রসার করা হয়েছে। ৮ হাজার ৭৭২ কোটি টাকায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প চলছে। ৭৭ হাজার মসজিদ ভিত্তিক মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মস্থান ও শিক্ষার জন্য নানা প্রকল্প চলছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষা, রেল, সড়ক, নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধিতে নানা প্রকল্প চলছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলীতে টানেল, কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ বিস্তারসহ নানা কার্যক্রম চলছে। দেশে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে।

সাফল্যের হাত ধরে নতুন বছরে পদার্পণ করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সামনে রয়েছে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে রয়েছে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাহস ও প্রত্যয়, যা শেখ হাসিনাকে বিশ্ব-নেতৃত্বের অনন্য নেতায় পরিণত করেছে। ২০২০ সালে নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে শুরু হচ্ছে বহুকাঙ্ক্ষিত ‘মুজিব বর্ষ’। সামনেই রয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বছর। ফলে নতুন এই বছর সরকারের কাছে এসেছে প্রণোদনা ও উদ্দীপনার আবহে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে সফলতার পথে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলার আহ্বান। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর