‘বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া কইরা, লঞ্চে আইয়া ঘুমাই থাকবে। চোখ খুলে দেকবে ঢাকা আইয়া গেছে। পদ্মাসেতু হোউক আর যতকিছু হোউক লঞ্চের আবেদন কোমবে না।’
পদ্মাসেতুর কারণে ফেরি বেকার হয়ে যাচ্ছে, রেলপথে যুক্ত হচ্ছে বরিশাল, কুয়াকাটা। ধারণা করা হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল রুটের বাসের সময় কমে আসবে উল্লেখযোগ্যভাবে। এমন পরিস্থিতিতে বরিশাল-ঢাকা রুটের লঞ্চের কি পরিণতি হবে। এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই একগাল হাসি দিয়ে এমন মন্তব্য করেন শ্রমিক নেতা পরিমল চন্দ্র দাশ। তারা এই পরিবর্তনকে পাত্তাই দিতে চাচ্ছেন না।
দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেতুটি এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জীবনযাত্রা এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দৃষ্টিকালচারেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বেকার হয়ে পড়বে ফেরিসহ ফেরি সংশ্লিষ্ট জীবন জীবিকা। মাওয়া ঘাটের অনেকেই পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। অনেকে গ্রামের বাড়ি (ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর) থেকে ঢাকায় গিয়ে অফিস করার স্বপ্ন দেখছেন। ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বের অনেক সিটির মতো ঢাকাতেও কর্মজীবীরা বাড়িতে এসে অফিস করে সন্ধ্যায় ফিরে যেতে পারবেন। সরকারও পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে সেভাবে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা সিটির বুকচিরে এক'শ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলবে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দেখা পাওয়া যাবে মেট্রোরেলের। তবে পদ্মার এই ধাক্কা লঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা।
মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাশ বলেন, ‘লঞ্চের যাত্রী কমবে না, দিন দিন বাড়বে। বাসে ফ্রি নিলেও অনেকে যাইবে না। তারা লঞ্চেই যাইবে। লঞ্চের মতো আরাম কেউ দেতে পারবে না। ভিআইপি কেবিনে গেলে মনে হয় এক্কেরে সোনারগাঁও হোটেলের রুমে আছি। ফাইভ স্টার হোটেলে আছি।’
বরিশাল লঞ্চ ঘাটের বার্দিম সারেং সানোয়ার হোসেনও অভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বাসে ঢাকা যেতে হলে কম করে হলেও ৫'শ টাকা লাগে। লঞ্চে ডেকে দেড় থেকে দু'শ টাকায় ঢাকা যাওয়া যায়। বাসে কিংবা ট্রেনে হলে সিটে যেতে হবে, আর লঞ্চে সারারাত শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারবে। সকালে দেখতে পাবেন অনেক যাত্রী গোসল করে ফ্রেস হয়ে পুরোদমে কাজ করতে পারছেন। আবার পরের রাতে একইভাবে ফিরতে পারছেন। আর সময়েরও কোনো হেরফের হয় না। লঞ্চের যাত্রী কমার সম্ভাবনা দেখছি না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বরিশাল রুটে ৮টি কোম্পানির ১৭টি লঞ্চ চলাচল করে। প্রতিদিন উভয় পাশ থেকে সাত থেকে আটটি লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২'শর মতো কেবিন রয়েছে। তবুও কাড়াকাড়ি লেগে যায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে। অনেককে যাত্রার তারিখ পরিবর্তন করতে হয় টিকেট না পেয়ে। আমার জানামতে নতুন আরও তিনটি লঞ্চ নির্মাণাধীন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে কুয়াকাটা ৫, পারাবত ১৮ ও অ্যাডভেঞ্চার ১১।
একটি সূত্র জানায়, একেকটি লঞ্চ ৩০০ থেকে হাজার যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। যদিও এখানে কৌশলগত কারণে অর্থাৎ রাজস্ব ফাঁকি দিতে এই সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়। ঘোষিত যাত্রীর সংখ্যার আনুপাতিক হারে বার্ষিক নবায়ন ফি দিতে হয়। যাত্রী প্রতি নবায়ন ফি ধার্য রয়েছে ৭০০ টাকা। এই রাজস্ব ফাঁকি দিতে মালিক ও কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে চলে আসছে কারসাজি। সে হিসেবে একটি লঞ্চ প্রায় ৯০টির মতো বাসের যাত্রী টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
পারাবত-১০ লঞ্চের একজন স্টাফ জানিয়েছেন, লঞ্চটির বরিশাল থেকে ঢাকা যেতে প্রায় ৭০ হাজার টাকার তেল খরচ হয়। আর তাদের কেবিন থেকে আসে দেড় লাখের মতো। ডেকে ৮'শর মতো যাত্রী যেতে পারে। দু'শ করে হলেও প্রায় দেড় লাখের মতো ভাড়া আদায় হয়। মালামাল বহন থেকেও ভালো আয় রোজগার হয়।
চ্যালেঞ্জার-১ লঞ্চের একজন স্টাফ জানিয়েছেন, তাদের লঞ্চে হোটেল এ ক্যান্টিনের জামানত বাবদ আয় হয়েছে ৬০ লাখ টাকা।
এই রুটে যাত্রীদের দিনদিন রুচিতেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বড় এবং ভালো ডেকোরেশন লঞ্চের কেবিন সবার আগে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে চলছেন মালিকরা। একটির থেকে আরেকজন বড় লঞ্চ নামাচ্ছেন। কোম্পানিগুলো তাদের ছোটো লঞ্চ অন্য রুটে সরিয়ে দিচ্ছেন। এখন সবগুলোই প্রায় তিন তলা বিশিষ্ট এবং দৈর্ঘ্যের দিক থেকেও প্রায় ৩শ ফুটের অধিক। তাই এখন একটু পুরনো হলেই ডকে পাঠিয়ে দিয়ে নতুন করে ডেকোরেশন করে নামানো হচ্ছে। সাধারণ কেবিনের পাশাপাশি সেমি ভিআইপি, ভিআইপি ও ডুপ্লেক্স কেবিন শোভা পাচ্ছে।
সিঙ্গেল কেবিন ১ হাজার, ডাবল -১ হাজার ৮০০ টাকা এবং ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ১০ হাজার পর্যন্ত রয়েছে। যা ঢাকা বরিশাল প্লেন ভাড়ার প্রায় চারগুণ বলা চলে।