টানা দুই সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সকালে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে জনপদ। দুপুরে অল্প সময়ের জন্য দেখা মিলছে সূর্যের। তবে সেই অনুপাতে বাড়ছে না তাপমাত্রা। বিকেল গড়াতে ফের নেমে আসছে কনকনে ঠান্ডা। সঙ্গে শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মার হিম হাওয়া হাড় কাঁপাচ্ছে মানুষের।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক আনোয়ারা খাতুন বার্তা২৪.কমকে জানান, মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে রাজশাহীতে সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আগের দিন সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী দুইদিন তাপমাত্রা আরও কমতে পারে বলেও জানান তিনি।
টানা শীত ও কুয়াশায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে ঠিক সময়ে কর্মস্থলে যেতে পারছেন না তারা। আবার শীত ও কুয়াশার কারণে কমে গেছে দৈনন্দিন হিসেবে কাজের ক্ষেত্রও। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ায় আয় কমছে তাদের। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে এই শ্রমজীবীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবী মানুষ নির্মাণ কাজ, পদ্মায় মাছ ধরে ও নৌকা চালিয়ে এবং নগরীতে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। শীতে নির্মাণ শ্রমিকদের ভোরে কর্মস্থলে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় সন্ধ্যা অব্দি কাজ করতে বাধ্য করছে ঠিকাদাররা। তীব্র শীতে সকাল ও সন্ধ্যায় রাস্তায় যাত্রী সংকটে অটোরিকশা চালকদের ভাড়া হচ্ছে একদম কম। আর নদী-কেন্দ্রিক শ্রমজীবী মানুষ কনকনে ঠান্ডায় নামতে পারছেন না কাজে।
মঙ্গলবার নগরীর তালাইমারীতে সড়কের ডিভাইডারে বসে থাকতে দেখা যায় কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষকে। তাদের একজন সুবিমল দাস। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। তার বাড়ি নগরীর জাহাজঘাট এলাকায়। তিনি জানালেন, গত দুইদিন ধরে বাড়িতে বসে আছেন। কোনো কাজ পাচ্ছেন না। একজন ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতেন।
সুবিমল বলেন, 'মালিক (ঠিকাদার) বলছে- শীতের সময়ে দিন ছোট হয়। আবার কাজে আসতে শ্রমিকরা দেরি করে। তাই আগামী দুই মাস তিনি তার বিল্ডিংয়ের কাজ বন্ধ রাখছেন। মার্চ থেকে আবার কাজ হবে। কিন্তু এই দুই মাস কী খেয়ে বাঁচবো। কিছু না কিছু তো করতে হবে। সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। কেউ কাজ দিল না। এখানে বসে আছি, দেখা যাক কী হয়।'
নগরীর টি-বাঁধ এলাকায় নৌকা মেরামতের কাজ করেন ৪৮ বছর বয়সী আলিমউদ্দিন। শুষ্ক মৌসুমে প্রচুর কাজ পান তিনি। কিন্তু শীতের কারণে পাচ্ছেন না জানিয়ে বলেন, 'এমন টানা শীত পড়লে কেউ কী নদীতে নামতে চায়? সেজন্য নৌকা মেরামতও করার তাগিদ নেই কারও। কিন্তু আমার তো পেটের দায়ে কাজ খুঁজতে বের হতেই হয়।'
স্টেশন এলাকায় অটোরিকশা রেখে পলিথিন জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন ইয়াকুব আলী। নওগাঁ থেকে রাজশাহী এসে ভাড়ায় অটোরিকশা চালান তিনি। আয়-রোজগার কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আর মামা বলেন না, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মালিকের সাথে বচসা করতে হয়। শীতের দিনে ভাড়া হয় না। অথচ মালিককে দিনে ৪০০ টাকা জমা দিতেই হবে। নির্ধারিত টাকা জমা না দিলে পরের দিন রিকশা দেয় না। দুই/তিন আগে ৪০০ টাকাও আয় হয়নি। পকেট থেকে ৬০ টাকা দিয়ে মালিককে নির্ধারিত টাকা জমা করতে হয়েছে। এভাবে কী চলে বলেন? খুব কষ্টে আছি।'
জানতে চাইলে জেলা অটোরিকশা ও টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি শরিফুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'শীতের কারণে চালকদের আয় একেবারে কমে গেছে। অনেকে অটোরিকশা জমা দিয়ে দেশের বাড়ি চলে গেছে। জানিয়েছে শীত কমলে আসবে। আসলেই এই শীতে শ্রমিকদের কাজ-কর্মও নেই, আয়ও নেই।'
ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের (ইনসাব) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি রবিউল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'শ্রমিকদের কাজ করাটা এখন দায়। টানা শীত ও কুয়াশা লেগেই আছে। পুরে পৌষ মাসটা এবার কনকনে শীতে কাটলো। দিনও ছোট। সকালে একটু দেরিতে আসলে শ্রমিকদের প্রতি ঠিকাদাররা অসন্তুষ্ট হচ্ছে। নানা ঝগড়া-ঝাটি করছে। আমাদের কাছে অভিযোগও আসছে। কিন্তু কিছু করার নেই।'