রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট ফুটপাতে রোজ বিকেলে ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। হাঁক-ডাক ছেড়ে ক্রেতা ধরেন তারা। শীতের এক সন্ধ্যায় জিরো পয়েন্টে দাঁড়াতেই কানে এলো একজন বৃদ্ধ নারীর কণ্ঠ। যেন বাহারি রঙের ফুলের মাঝে বসে আছেন ‘পুষ্পরাণী’! কথা বলে জানা গেল তার নাম দুর্গা রাণী।
গায়ে ময়লা-জীর্ণ শীতের কাপড় জড়ানো বৃদ্ধা ক্ষীণ কণ্ঠে বলছেন, ‘এই মামা, ভার্সিটির মামা- দুটো গোলাপ নিয়ে যান গো।’ কিন্তু তার ডাকে ক্রেতাদের তেমন সাড়া নেই। একটু এগিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতেই সেখানে এলেন ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি। জানালেন সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী।
দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ফুল বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন অজুর্ন-দুর্গা দম্পতি। আশির দশকের শুরুর দিকে যখন সাহেববাজারে তারা ফুলের ব্যবসা শুরু করেন, তখন এখানে আর কোনো দোকান ছিল না। সময়ের পরিক্রমায় জিরো পয়েন্টে বেড়েছে ফুলের দোকান, আর আয় কমেছে অর্জুন-দুর্গা দম্পতির। আগে দোকানের আয় থেকে মোটামুটি সংসার চললেও এখন তা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বেকার দুই ছেলে, বিধবা মেয়ে ও দুই নাতি-নাতনির ভরণপোষণে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
অর্জুন রায় বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর চানাচুরের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। দুর্বৃত্তরা একদিন অফিসে আগুন ধরিয়ে দিল। তারপর কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না। তখন থেকে ফুলের ব্যবসা। প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ফুল তুলে এনে বিক্রি করতাম। খুশি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা টাকা দিতো। ভালোই চলতো।’
তবে ৯০ দশক থেকে ফ্রি'তে ফুল সংগ্রহ করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ফুল কিনতে শুরু করলাম। প্রথমে বগুড়া থেকে কিনে এনে বিক্রি করতাম। তবে বগুড়ার ফুলের দাম বেশি। পরে যশোর থেকে ফুল আনা শুরু করলাম। ট্রাকের চালকের হাতে টাকা দিলে তিনি ফুল এনে দিতেন। এখন বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেই। ভোরে ট্রাকে মালামাল রাজশাহী এসে যায়। দুপুরের পর থেকে বিক্রি শুরু করি।’
পাশে বসা দুর্গা রাণী এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে স্বামীর ফুল ব্যবসার ইতিহাস শুনছিলেন। নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘সব চোখের সামনে ভাসে। এইতো সেদিন। দেশে যুদ্ধ লাগল। সেই সময়ে ওর (অর্জুন) সাথে বিয়ে। সিরাজগঞ্জে আমার বাবার বাড়ি। মাঠে বাবার ১০০ বিঘার ওপরে জমি-জমা ছিল। দেশ স্বাধীনের সময় স্বামী, বাবা ও ভাইদের সাথে ভারতে চলে গেলাম। ওখানে গিয়ে বাবা মারা গেল। ভাইয়েরাও আর ফিরে আসেনি। স্বামী দেশে চলে আসলো, তার সাথে আমিও এলাম। ফিরে এসে আর এক শতক জমিও পায় নি।’
দুর্গা রাণী যেখানে ফুটপাতে ফুল বিক্রি করছেন, তার ঠিক পেছনে ছিল তার শ্বশুর বাড়ি। সেটা দেখিয়ে দুর্গা বলেন, ‘দেশে এসে উঠলাম এই বাড়িতে। আমার শ্বশুর বাড়ি। দালান ঘর ছিল এখানে। কিন্তু কোনো আয়-রোজগারের পথ ছিল না। ও (অর্জুন) ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। সেটা বন্ধ হওয়ার পর এই ব্যবসা। তারপরতো সেই বাড়িঘরও কেড়ে নিল নেতারা। মাত্র ১২ হাজার টাকা দিয়ে মার্কেট করার জন্য জমিসহ সেই বাড়ি-ঘর নিয়ে নিল।’
সাহেববাজার বড় মসজিদের পেছনে এখন ২৫০০ টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন তারা। এক কক্ষ বিশিষ্ট বাসাতে কোনো মতে রাত্রিযাপন করেন পরিবারের আট সদস্য। আর্থিক অনটনে তিন সন্তানের কাউকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। নিজস্ব বাড়ি-ঘর আর আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ৩৮ বছর বয়সেও বিয়ে করাতে পারেননি বড় ছেলেকে। ছোট ছেলের বয়সও ৩৩। তিনিও বেকার। মাঝে-মধ্যে ফুলের দোকানে বসেন।
এবার অর্জুন রায় বলতে শুরু করেন, ‘ব্যবসা ভালোই ছিল। কিছু সঞ্চয়ও করেছিলাম। কিন্তু দুর্গা মাঝে-মধ্যেই অসুস্থ হয়ে যায়। হার্টের সমস্যা, প্যারালাইজড। অনেক পয়সা খরচ হয়েছে ওর চিকিৎসায়। কত জনের কাছে ধর্ণা দিলাম। মেয়র, এমপি, ডিসি কেউ এক পয়সাও সাহায্য করেনি। ভোটের সময় ঠিকই এসে ভোট চান সকলে।’
সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে নিয়োগ পেতে বছর দশেক আগে আবেদন করলেও সাড়া মেলেনি জানিয়ে বলেন, ‘একবার পথ দিয়ে যেতে মেয়র লিটন (এএইচএম খায়রুজ্জামান) হঠাৎ আমাদের দেখে বলে গেল- আবেদন করতে। চাকরি দেবে বলেছিল। আবেদন জমা দিছি ১১/১২ বছর আগে। কোনো সাড়া মেলেনি। বরং এখানে ফুটপাতে বসার জন্য সকাল-বিকাল চাঁদা দিতে হয়। সিটি করপোরেশনের নাম করে টাকা তোলে তারা।’
এবার দুর্গা রাণীর কণ্ঠে বিরক্তির সূর! স্বামীর দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে বলে ওঠেন, ‘ছাড়ো তো! চাকরির দরকার নেই আমাদের। যতদিন বেঁচে আছি, ফুল বেচে খাবো। ৪০ বছর পার করলাম, আর ক’বছরই বা বাঁচবো! মানুষেরা চাকরি করুক, আয়-রোজগার করে হাসিখুশি থাকুক। আমাদের থেকে ফুল কিনুক! তাতেই খুশি আমরা’ বলে হেসে ওঠেন দুর্গা।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়েন স্বামী অর্জুন রায়ও। সেই দৃশ্য দেখলে মনে হবে- জগতের সবচেয়ে সুখী দম্পতি যেন আলো ছড়াচ্ছে রাজশাহীর সাহেববাজারে জিরো পয়েন্টে।