রোহিঙ্গা নিয়ে আইসিজের আদেশ মিয়ানমার কি তা মেনে চলবে? এমন প্রশ্ন এখন সবার মনে। যদি মেনে না চলে, তাহলে দেশটির ওপর কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক বলেন, এখন আর আগের মত সব কিছু অস্বীকার করার দিন শেষ। মিয়ানমারের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন পর্যবেক্ষণ করা হবে।
মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে এ রায়ে বলা হয়েছে, অবশ্যই মুসলিম নৃগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হবে এবং এ জন্য তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সম্পর্কে রিপোর্ট করতে হবে।
২৩ জানুয়ারি জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে আশ্চর্যজনক দৃঢ় রায়টি দিয়েছেন, তা দেশটির মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন সমালোচকরা। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গারা সরকার অনুমোদিত গণহত্যার শিকার হয়েছে।
হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার জন্য এবং মিয়ানমার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার রিপোর্ট নিয়মিত দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ আদেশের কয়েকদিন পার হলেও দেশটির প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যা চালানোর কথা অস্বীকার করা ছাড়া এ রায় সম্পর্কে দেশটির সরকার প্রায় কিছুই বলেনি।
জার্মান আইন বিভাগের অধ্যাপক ক্লজ ক্রেস গাম্বিয়ার পক্ষে আদালতে ছিলেন।
তিনি বলেন, গাম্বিয়ার মামলায় ১৫ বিচারকের প্যানেলের সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিয়ানমার এবং গাম্বিয়াকে প্যানেলের সদস্য নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্যানেলে দুই দেশের পছন্দ অনুযায়ী একজন করে সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইংল্যান্ডের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টারের সিনিয়র প্রভাষক কার্লা ফার্স্টম্যান বলেন, এটি বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ রায়। এ রায়ের পর মিয়ানমারের পক্ষে কেবল খারাপ কাজ করা এড়ানো যথেষ্ট নয়, তাকে অবশ্যই সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তারপর রিপোর্টিংয়ের স্পষ্ট সময়সূচিসহ এটির প্রমাণ দিতে হবে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনী হামলা চালানোয় মিয়ানমার বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছে, যার ফলে ২০১৭ সাল থেকে সীমান্ত পেরিয়ে সাত লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যোগ করেন তিনি।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক গ্লোবাল জাস্টিস সেন্টারের সভাপতি আকিলা রাধাকৃষ্ণান বলেন, আদালত নিশ্চিত করেছে যে গণহত্যা যেখানেই ঘটুক না কেন, এটি পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিষয় এবং যে কোনো রাষ্ট্রে গণহত্যা বা এমনতর কিছু হলে প্রতিরোধ, অবসান ও শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে পারে আইসিজে।
গাম্বিয়া, ৫৭ দেশীয় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার পক্ষে মামলাটি নিয়ে এসেছে, আদালতকে মিয়ানমার গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে, তা ঘোষণা করতে বলেছে। এ বিচার কয়েক বছর ধরে চলতে পারে।
তবে ২৩ জানুয়ারির রায় অনুসারে আদালত মিয়ানমারকে তার দেশে থাকা প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো রোধ এবং গণহত্যার কোনো প্রমাণ নষ্ট হওয়া রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গাম্বিয়া কেবলমাত্র একটি প্রতিবেদন চেয়েছিল। কিন্তু গাম্বিয়া যা চেয়েছিল, তার চেয়েও বেশি এগিয়ে গিয়ে আদালত মিয়ানমারকে এ মামলাটি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। চার মাসের মধ্যে প্রথম প্রতিবেদন দেওয়ার কথা।
এ আদালতের কোনো শাস্তি প্রয়োগের ক্ষমতা নেই, তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল তার ফলাফলগুলো আয়ত্তে এনে কার্যকর করতে পারে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক বলেন, ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল, আন্তোনিও গুতেরেস এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি এটিকে সরাসরি সুরক্ষা কাউন্সিলে পাঠাবেন। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। কোনো কিছু পর্যালোচনা না করেই সরাসরি নিরাপত্তা কাউন্সিলে পাঠানোর মহাসচিবের এ ঘোষণা গুরুত্ব বহন করে।
আকিলা রাধাকৃষ্ণান বলেন, মিয়ানমার যদি এ আদেশ অমান্য করে, তবে দেশটি অধিকার রক্ষায় বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। কারণ ২০১১ সালে আংশিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকে দেশটি যে মানবাধিকার ভোগ করেছে তা প্রশ্নের মুখে পড়বে।
এখন, এ ধরনের স্পষ্ট আইনি বাধ্যতামূলক আদেশ মেনে চলা ব্যর্থ হলে মিয়ানমারকে সত্যিকারের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার স্টেট ডিপার্টমেন্টে কূটনীতিক এবং বর্তমানে গাম্বিয়ার আইনি দলে থাকা আইনজীবী আরসালান সুলেমান বলেন, এটি অত্যন্ত দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং এটি বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গাদের আশা জাগিয়ে তুলেছে।
তিনি গাম্বিয়ার ‘নৈতিক নেতৃত্বের’ প্রশংসা করে বলেন, এটি প্রায়ই বিশ্ব মঞ্চে অভাব বোধ করে।
গাম্বিয়া আফ্রিকার একটি দেশ। যা অত্যন্ত উন্নত দেশ নয়, এমন একটি দেশ, যা সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার এবং মর্যাদার বিষয়ে চিন্তা করে এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াই করার জন্য এটি আন্তর্জাতিক উদ্বেগ তৈরি করেছে।