রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অধীনস্থ মতিহার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ব্রজ গোপাল। ২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে ২০১৭ সালের জুলাইয়ের মধ্যেই তার হাতে আসে আইসিটি আইনের চারটি মামলা। ওই মামলাগুলোর তদন্তের শুরুতে প্রয়োজন পড়ে আসামির বিরুদ্ধে মামলার বাদীর দেওয়া তথ্য যাচাই করার।
কিন্তু ঢাকায় ফরেনসিক ল্যাবে প্রতিটি মামলার নথি পাঠানোর পর রিপোর্ট পেতেই আড়াই থেকে তিন মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। ফলে ছয় মাসেও তদন্তের কাজ শুরু করতে পারেননি তিনি। এর মধ্যেই তাকে বদলি করা হয় আরেক থানায়। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তাকে শুরু করতে হয় সেই গোড়া থেকেই। ফলে সেই চারটি মামলা এখনো ঝুলেই আছে, আদালতে জমা পড়েনি চার্জশিট।
ফরেনসিক ল্যাব না থাকায় বিভাগীয় শহরের প্রত্যেকটি থানার তদন্ত কর্মকর্তাকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আর জেলা শহর বা মফস্বলের থানাগুলোতে দায়েরকৃত মামলার তথ্য-উপাত্ত ফরেনসিক ল্যাবে যাচাই করতে পাঠানো এবং রিপোর্ট হাতে পাওয়া বিশাল ব্যাপার! ফলে মামলা পড়ে থাকে বছরের পর বছর। বিচার পাননি বাদীপক্ষ।
পুলিশ কর্মকর্তাদের এমন সমস্যার কথা বারবার উঠে এসেছে বিভিন্ন মিটিংয়ে। দাবি ছিল- রাজশাহীতে ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠার। সেই দাবি মেনে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) চালু করা হয়েছে ফরেনসিক ল্যাব। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ল্যাবের উদ্বোধন করেন। এই ল্যাবে রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলো ছাড়াও রংপুর বিভাগের থানাগুলোর মামলার তথ্য-উপাত্ত যাচাই করার সুযোগ থাকবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামি শনাক্ত ও মামলার তদন্তে গতি আসবে বলে মনে করছেন সিআইডির কর্মকর্তারা।
সিআইডি সূত্র জানায়, ক্লু-লেস বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটন ও বিভিন্ন আলামত, ডিএনএ ও সাইবার টেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ আলামত পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা রহস্য উদঘাটনে ঢাকার ফরেনসিক ল্যাবে যোগাযোগ করতে হয় সংশ্লিষ্টদের। এতে সময় বেশি প্রয়োজন হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট দিতেও দেরি হয়। ফলে মামলার তদন্ত কাজ আটকে থাকে। এজন্য বিভাগীয় পর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
রাজশাহী সিআইডির ফরেনসিক শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) আব্দুর রহিম বলেন, ‘রাজশাহীর পরীক্ষাগারটিতে রাসায়নিক, ব্যালিস্টিকস, হস্তলিপি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, অণু বিশ্লেষণ, ফুটপ্রিন্ট ও জালনোট শনাক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। এরমধ্যে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে ভিসেরা, নারকোটিক ও অ্যাসিড টেস্টসহ আরও কয়েকটি আইটেম পরীক্ষা করা হবে।’
ল্যাব সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী- রাসায়নিক পরীক্ষাগারের মধ্যে রয়েছে সব ধরনের মাদকদ্রব্য, মৃত মানুষ ও পশু-পাখির ভিসেরা, কবর থেকে উত্তোলিত হাড়, চুল, মাটি ও সফট টিস্যু, বিষাক্ত বা চেতনানাশক পদার্থের উপস্থিতি, রক্ত মিশ্রিত আলামতে রক্তের উপস্থিতি, অ্যাসিড মিশ্রিত আলামতে রক্তের উপস্থিতি, বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ, জাল টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল, জিএসআরসহ বিভিন্ন আলামতের রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে মতামত দেওয়া।ৎ
ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখার মধ্যে রয়েছে ক্রাইমসিন থেকে সংগৃহীত দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে সন্দেহভাজনদের আঙ্গুলের ছাপের তুলনামূলক পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া এবং সংগৃহীত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ল্যাটেস্ট প্রিন্ট এএফআইএস ডাটাবেজে সংরক্ষিত ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে তল্লাশি করে মিল বা অমিল সম্পর্কে মতামত দেওয়া। হস্তলিপি শাখার কাজ হচ্ছে বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় বিবদমান দলিলের লেখা বা স্বাক্ষর জাল, নম্বর ঘষামাজা করে বা রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করে অবমোচন করা হলে তা পরীক্ষা করে মতামত দেওয়া।
জালনোট ও মেকি মুদ্রা শাখার কাজ হচ্ছে দেশি-বিদেশি সকল কারেন্সি নোট ও কয়েন বা ধাতব মুদ্রার বিষয়ে ভিডিও স্পেট্রাল কম্পারেটরের মাধ্যমে নোটের দৃশ্য-অদৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে মতামত দেওয়া। ফটোগ্রাফি শাখার কাজ হচ্ছে অপরাধীদের ছবি গ্রহণ, সংরক্ষণ, ফরেনসিক বিভিন্ন শাখার আলামতের বর্ধিত ছবি সরবরাহ করা এবং বিতর্কিত ছবির সঙ্গে নমুনার মিল আছে কি না তা বিশ্লেষণ করে মতামত দেওয়া।
ব্যালিস্টিক শাখার কাজ হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট কোনো অপরাধের ঘটনায় উদ্ধারকৃত বা অপরাধে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, কার্তুজ ও ফায়র্ড বুলেট বা এসবের কোনো অংশ বিশেষ পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া। অণুবীক্ষণ শাখার কাজ হচ্ছে গাড়ির ইঞ্জিন, চেসিস নম্বর, আগ্নেয়াস্ত্রের নম্বর, ট্রেড মার্ক তৈরিকারী দেশের নাম এবং কোনো ধাতব বস্তুর উপর থেকে মুছে ফেলা/বিকৃত করা, ক্রমিক নম্বর সংখ্যা বা যেকোনো চিহ্ন পরীক্ষা করে মতামত দেওয়া।
পদচিহ্ন শাখার কাজ হচ্ছে পায়ের বা জুতার ছাপ পরীক্ষা করে অপরাধী বা ভুক্তভোগী শনাক্তকরণে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া। এছাড়া ক্রাইমসিন ইউনিট অপরাধের স্থল পরিদর্শন করে বস্তুগত সাক্ষ্য সংগ্রহ, ডকুমেন্টেশন, সংরক্ষণ করে বস্তুগত সাক্ষ্য সংশ্লিষ্ট থানা বা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিবে।