প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে মদন বাবুর কুপির আলো

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর | 2023-08-31 22:01:07

মদনলাল আর বাবুলাল। সম্পর্কে তারা দুজন ভাই। পেশায় বাতির কারিগর। টিন দিয়ে কুপি তৈরি করেন তারা। আর এই কুপি বেচে সংসার চলে তাদের। কিন্তু দিনকে দিন আধুনিক প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়েছে মদন বাবুর কুপির আলো। তাই দিনকে দিন দুই ভাইয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

হাড়ভাঙা শ্রম মদন বাবুর নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা বিরামহীন টিন হাতুড়ের খুট খাট আওয়াজ। এভাবে টিনের ল্যাম্প কুপি, কৌটা, মগ আর ক্যালেন্ডারের বিট তৈরি করে তারা। বিনিময়ে চাল-ডালের যে দু’টো পয়সা জুটে, তাই নিয়ে খুশি।

 একটা ঝুপড়ি ঘরে চলে কুপি তৈরির কাজ

কুপি তৈরি করে জীবনের ষাট বছর পার করেছেন তারা। পাকিস্তান আমলে শুরু তাদের কুপি তৈরির কাজ। অন্যের ঘরে বাতির আলো পৌঁছাতে গিয়ে কত কিছুই না দেখেছেন তারা। কিন্তু তাদের দিকে কেউই তাকায় নি। দেশ স্বাধীনের পর থেকে কুপির আলো পড়তির দিকে। এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে মদন বাবুর সংসারে বাতির নিচে অন্ধকার।

রংপুর মহানগরীর কালিবাড়িতে একটা ঝুপড়ি ঘরে তাদের কুপি তৈরির কারখানা ছিলো। এখন প্রেসক্লাবের বিপরীতে পুরাতন ধর্মসভার কোলঘেঁষে একটা ছাপড়ায় সারাদিন খুটখাট করে কুপি তৈরি করেন দুই ভাই।

বয়সে দুই বছরের ছোট বড় এই দুই ভাইয়ের ঘাড়ে এখন একই চিন্তা। তাদের অভাব অনটনের ঘরে রয়েছে বিয়ের উপযুক্ত কন্যা। সাথে স্ত্রী-সন্তানদের একটু সুখের জন্য আহাজারি। এমন পরিস্থিতিতে জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করলেও থেমে নেই মদন বাবুর ভালো থাকার যুদ্ধ।

জীবনের ষাট বছর বয়সেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন মদন বাবু

বার্তা২৪.কম-এর সাথে আলাপকালে মুচকি হেসে মদনলাল পাল শোনালেন জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা ত্যাগ'র একটি গানের সুর। 'তেল গেল ফুরাইয়া, বাতি যায় নিভিয়া, কি হবে আর কান্দিয়া'- এই সুর ধরে রোগা শরীরে কাশতে কাশতে তিনি বলেন, এখন তেল থাকলেও কুপি অচল। ঘরে ঘরে বাল্ব জ্বলে। মানুষ এখন আর ল্যাম্প (কুপি) কেনে না।

মদনলালের ভাষায়, 'এক সময় দিনে খুচরা-পাইকারি মিলে একশ’রও বেশি কুপি বিক্রি হতো। এখন মাসেও ১০টাও বিক্রি হয় না। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির আলোয় সবাই আলোকিত। অথচ সারাজীবন মাইনস্যের (মানুষের) টিনের বালতি, বাসন-কোসন জোড়াতালি দিবার যায়া নিজের জীবনটাই আর জোড়াতালি দেয়া হলো না।’

কোনোদিন আড়াইশ আবার কোনোদিন একশ টাকাও রোজগার হয় না

বড় ভাইয়ের কথার ফাঁকে কথা জুড়ে দেয় ছোট ভাই বাবুলাল পাল। বললেন, 'বড় ভাই মদনলালের নাকি আগের মতো কষ্ট নেই। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলের একজন শিক্ষক, বাকি দু’জন ব্যবসায়ী। কিন্তু যত বিপদ তার ওপর। থাকার মতো একশতক ভিটে মাটি রয়েছে। কোনোরকম আয় রোজগারে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ঘরে আরো দুই মেয়ে আছে। একমাত্র ছোট ছেলেটা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ছে।' এসব কথা বলতে বলতে থমকে গেলেন বাবুলাল। যেন দুঃখের ভাঁড়ে তার দম খাটো হয়ে আসছে।

কিছুক্ষণ পর বাবুলাল পাল বললেন, দিন গেলেই বাড়ির খরচ কম করে হলেও তিনশ টাকা লাগে। কোনদিন আড়াইশ হয়, আবার একশ টাকাও রোজগার হয় না। অথচ বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম বেশি।

এসময় তারা দুই ভাই জানান, সময়ের সাথে সাথে অনেকেই পেশা বদল করেছেন। সবখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু অন্য কোনো কাজকর্ম জানা না থাকায় বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের কোনোমতে সংসার চলছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর