ঋতু বদলে শীতকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতিতে এখন বসন্ত। তবে এখনো রাজশাহীতে পুরোপুরি কাটেনি শীতের আমেজ। দিনভর সূর্যের প্রখরতা থাকলেও সকাল-সন্ধ্যে নিয়ম করে পড়ছে মৃদু ঠান্ডা। ফলে এখনও নজর কাড়ছে পদ্মায় পরিযায়ী পাখিদের জলকেলির মনোরম দৃশ্য।
পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীত শেষে গরমের আভাস শুরু হলে পরিযায়ী পাখিরা অবস্থান বদল করতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিক থেকে তারা দেশান্তর হয়ে থাকে। তবে গেল কয়েক বছর ঋতু সংশ্লিষ্ট আবহাওয়ার ধরণ বদল হওয়ায় মার্চ পর্যন্ত পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলছে।
জানা যায়, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাজশাহীর পদ্মা নদীতে প্রথমবারের মতো পাখিশুমারি করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) পরিচালিত শুমারিতে পদ্মায় দেখা মেলে ৩৭ প্রজাতির পাখি। যার মধ্যে ২৭ প্রজাতি ছিল পরিযায়ী শ্রেণিভুক্ত পাখি। জলকেলি করতে দেখা গেছে বিরল প্রজাতির এক জোড়া পাতি মার্গেঞ্জারকেও।
শুমারির পরদিন (৬ জানুয়ারি) রাজশাহীর পবায় পদ্মার মাঝারদিয়াড় চরে পুরুষ পাতি তিলিহাঁসের গায়ে জিপিএস ট্র্যাকার বসানো হয়। পাখিটির অবস্থান ও গতিবিধি নির্ণয় এবং আচরণগত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে এটি করা হয়। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার অবস্থানের হালনাগাদ দেখতে পারছেন ট্র্যাকার নিয়ন্ত্রণকারী।
তবে ট্র্যাকার লাগানোর ৪২ দিন পর এখনও পদ্মায়-ই অবস্থান করছে সেই তিলিহাঁস। ট্র্যাকার লাগানোর পর থেকে মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পুরুষ ওই তিলিহাঁসটি ভ্রমণ করেছে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। তবে ঘটনাস্থলের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যেই চলাফেরা করছে হাঁসটি।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে বার্তা২৪.কম-কে এমন তথ্য জানিয়েছেন আইইউসিএন’র সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সীমান্ত দীপু। তিনি বলেন, ‘ট্র্যাকিংয়ে তিলিহাঁসের সবশেষ অবস্থান পদ্মা থেকে ভারতের ৪৫ কিলোমিটার ভিতরে। জিপিএস লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর হাঁসটি সবসময় ৫০ কিলোমিটার রেডিয়াসে ঘটনাস্থলের আশেপাশে ঘুরছে। এখনও এটি মাইগ্রেট বা পরিযান শুরু করেনি।’
মধ্য মার্চে তিলিহাঁস দেশান্তর হতে শুরু করবে বলে মনে করেন পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সীমান্ত দীপু। তার মতে, পদ্মায় গরমের প্রভাব এখনও নেই বললেই চলে। শীতের আমেজ থাকায় ওরা দলবেঁধে স্বাভাবিক নিয়মে জলকেলি করছে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো দলবেঁধে পরিভ্রমণ শুরু করবে।
বণ্যপ্রাণী গবেষক সারোয়ার আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘পরিযায়ী পাখিরা ক্যালেন্ডার সময় মেপে যাতায়াত করে না। তারা আবহাওয়ার তারতম্য অনুভব করে চলে। তারা থাকে এক জায়গায়, খাবার খেতে যায় আরেক জায়গায়। পাশে খাবার থাকলেও তারা ভিন্ন জায়গায় গিয়ে খেয়ে আসে। যা পরিযায়ী পাখিদের খুবই চমৎকার একটি আচরণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এপ্রিল থেকে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে এদের প্রজনন ঋতু। ফলে মার্চে বা মধ্য মার্চে ফিরতে শুরু করলেও সাইবেরিয়া বা তাদের কমফোর্ট জোনে পৌঁছে যাবে। কারণ এরা কম বিশ্রামে বেশ জোরে উড়ে চলতে পারে। দ্রুত দিক পরিবর্তনেও পারদর্শী।’
একনজরে পাতি তিলিহাঁস:
এরা ২৮০ থেকে ৩২০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। ছেলে ও মেয়ে হাঁসের চেহারায় পার্থক্য স্পষ্ট। ছেলে হাঁসের মাথা তামাটে, শরীলে সূক্ষ্ম দাগে ভরা। চোখের পাশে সবুজ পট্টির চারদিকে হলুদে ঘেরা। হলুদ লেজে কালো বর্ডার এবং কালো ঠোঁট। মেয়ে হাঁসের গাঁয়ের রঙ হালকা বাদামি, দেহতল ফ্যাকাসে, সবুজ আভাসহ হলদে-বাদামি ঠোঁট। পায়ের পাতা হালকা নীল বা জলপাই ধূসর।
পাতি তিলিহাঁস সাধারণত নদী, হাওর, খোলা জলাভূমিতে ঝাঁক ধরে বিচরণ করে। জলজ লতাপাতার কচি কাণ্ড ও বীজ এদের প্রিয় খাবার। পানিতে হঠাৎ দলবেঁধে খাড়া হয়ে বসে এবং ঠোঁট উপরের দিকে তুলে ‘ক্রিট, ক্রিট, ক্রিট…’ সুরে ডাকে।
প্রজননের সময় ঠান্ডা কোনো অঞ্চলের জলাশয় বা জলাবদ্ধ এলাকায় শুকনো পাতার ভিতরে কোমল পালক বিছিয়ে বাসা বানায়। একটি মেয়ে তিলিহাঁস ৮ থেকে ১১টি ডিম দেয়। তিন সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফুঁটে। এর ২৫ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে বাচ্চা একা চলতে শিখে যায়।
পাতি তিলিহাঁসের ইংরেজি নাম ‘কমন টিল’। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল ও ইউরোপে পাখির বিচরণ দেখা যায়। আইইউসিএন পাখিটিকে ‘কম বিপদগ্রস্ত’ পাখিদের তালিকায় রেখেছে। বাংলাদেশে এই পাখি শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।