ঢাকা: কোনো হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার হতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ও সার্জিক্যাল সামগ্রী, কোনটাতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত সংরক্ষণ, কোথাও আবার অস্ত্রোপচার কক্ষে নোংরা পরিবেশ। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে ডায়াগনস্টিক টেস্টে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারের অবহেলা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ভুল চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রথম ধাপ মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট। র্যাবের মোবাইল কোর্ট অভিযানের পরিসংখ্যান বলছে, এই সব কারণে চলতি মাসেই প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র্যাব। তবুও এমন অপরাধ করে যাচ্ছে দেশের নামীদামী সব বেসরকারি হাসপাতাল গুলো।
ডায়াগনস্টিক টেস্টে রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান রি-এজেন্ট। রাজধানীসহ সারা দেশে নামীদামী বেসরকারি হাসপাতাল গুলো মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছে এমন অভিযোগে সরগরম দেশ। চিকিৎসা খাতের এই বেহাল দশায় শঙ্কিত সাধারণ রোগীরা।
আগুনে ঘি ঢালার মত র্যাব সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ, সার্জিক্যাল সামগ্রী, অস্ত্রোপচার কক্ষ নোংরা, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট এই সব কারণে র্যাব প্রতিষ্ঠা হতে জুন ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৪১১ টি অভিযান পরিচালনা করেছে। যাতে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৬৬৩ টি, আর নানা রকম অভিযোগে জরিমানা করেছে প্রায় ৪১ কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রত্যেকটি অভিযানে রি-এজেন্ট জনিত সমস্যা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় বলে জানিয়েছে র্যাব।
এদিকে চলতি মাসে (২ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডি-২ নম্বর সড়কের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুই বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার এবং ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করায় হাসপাতালটিকে জরিমানা করেছে। ৭ মাস আগে ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাসাপাতালটিকে একই অপরাধের ৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল এই ভ্রাম্যমাণ আদালত।
৩ জুলাই মিরপুরে গ্যালাক্সি ও আলোক হাসপাতালকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত । তাদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অপরাধ ছিল।
সর্বশেষ (২০ জুলাই) সাভারে দ্বীপ হাসপাতাল, সাভার সেন্ট্রাল হাসপাতাল ,প্রাইম হাসপাতাল, প্রিন্স হাসপাতাল , নিউ দ্বীপ হাসপাতাল, মুক্তি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৷ মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট , অপারেশন থিয়েটার হতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ এবং সার্জিক্যল সামগ্রী জব্দ করার পর সাড়ে ২২ লাখ টাকা জরিমানা করে তাদের।
এই সব অপরাধে অভিযুক্ত দেশের অন্যতম ব্যয়বহুল হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত 'এ্যাপোলো'। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুমোদনহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির দায়ে এ্যাপোলোকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নের (র্যাব-১) ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ঘটনার ৩ বছর আগে কমবেশি একই কারণে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করে এই হাসপাতালকে।
সম্প্রতি বহুল আলোচিত এই মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টের প্রভাবে ডায়াগনস্টিক টেস্টে কি প্রভাব ফেলে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কাজী নিশাদ আরা বেগম বার্তা২৪.কমকে বলেন, রোগীর রোগ নির্ণয়ের প্রধান ধাপ হল টেস্ট। রি-এজেন্টে যদি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, টেস্টের রেঞ্জে পরিবর্তন আসবে। এই টেস্টকে ভিত্তি হিসেবে ধরে, চিকিৎসা শুরু করলে পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়াই ভুল দিকে যাবে। রোগীর ভুল চিকিৎসা হবে, কেননা আমরা যে রেজাল্ট পাচ্ছি, সেটা আসল রেজাল্ট না।
ড. কাজী নিশাদ আরা বেগম আরও বলেন, কোন হাসপাতালের রি-এজেন্ট যদি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, আর সেটা যদি হাসপাতালটি ব্যবহার করে থাকে । সেটা নিছক অবেহেলা ছাড়া আমি কিছু দেখছি না।
বগুড়া আর্মি মেডিকেল কলেজের লেকচারার ডাঃ নাফিজা সুলতানা বার্তা ২৪.কমকে বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টের প্রভাবে টেস্টের রেজাল্ট কম বেশি হয়। তাছাড়া রি-এজেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হবার সুযোগ থাকে না বললেই চলে। ২ হাজার টাকায় ১ লিটার রি-এজেন্ট ছয়মাস এক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। একমাত্র অবহেলা জনিত কারণেই রি-এজেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হবার মত ঘটনা ঘটতে পারে।
এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হাসপাতাল গুলোর এই অবহেলা সম্পর্কে জানতে চাইলে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম হাসপাতাল কতৃপক্ষের বরাত দিয়ে বার্তা২৪.কমকে বলেন, এটা ঐ সব হাসপাতাল গুলোর গাফলতি, দায়িত্বহীনতা থেকেই এমন করে থাকে তারা। যেটা তারা স্বীকারও করে। তাছাড়া আরেকটা বিষয় আমি লক্ষ্যে করেছি, অনেকে আবার ইচ্ছে করেই এমন করে, পরীক্ষা করতে এসেছে করে দিলাম। আবার অজ্ঞাত কারণেও এমন হয়।
এই জন্য আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকি। যাতে ইন্টারনালি তারা টেক কেয়ার নিতে পারে। নিজেদের ভুল গুলো বুঝতে পারে। সুস্থ চিকিৎসা সেবা দিতে পারে।