প্রমত্তা পদ্মায় এখন বিস্তীর্ণ চর। চরজুড়ে শোভা পাচ্ছে সবুজ কাউন ক্ষেত। রবি মৌসুমে নভেম্বরে বোনা কাউনে জানুয়ারিতে বের হয় হলুদ শীষ। দু’সপ্তাহের ব্যবধানে চালের ভারে নুইয়ে পড়ে সেই শীষ। ঠিক তখনই কাউন চাল খেতে দলবেঁধে ক্ষেতে আসে বাবুই পাখি। চরতে আসা ডোরা বাবুই, কালোবুক বাবুইয়ের ভিড়ে হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে দেয় ‘তিন-রঙ্গা মুনিয়া’।
নজরকাড়া রঙের এ পাখিটি অতিসতর্ক। আচমকা উড়ে এসে বসে কাউন শীষে। ২০-২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতার কাউন শীষে কিছুক্ষণের জন্য দোল খায় ১০ গ্রাম ওজনের পাখিটি। চোখের পলকে নাচন দিয়ে বদল করে দিক। নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই কেবল নজর দেয় খাবারে। ঠুকরে ঠুকরে কাউনের শীষ থেকে চাল বের করে খায়। মানুষের উপস্থিতি আঁচ করলেই ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় এরা।
তিন-রঙ্গা মুনিয়া পাখির সবচেয়ে প্রিয় খাবার কাউন চাল। সঙ্গে চিকন ধান ও ঘাসবীজও খায় এরা। খাদ্যস্থল ছাড়া এদের দেখা মেলা ভার! ফলে পাখি নিয়ে কাজ করা গবেষক এবং ছবি তুলতে ফটোগ্রাফারদেরও বেগ পেতে হয় বেশ।
রাজশাহীর পদ্মাপারের শিমলা এলাকা থেকে তিন-রঙ্গা মুনিয়ার বেশ কিছু ছবি তুলেছেন ফটোগ্রাফার আকাশ মজুমদার। তিনি রাজশাহী বার্ডস ক্লাবের সদস্য। লেখাপড়া করেন ঢাকায় শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে। রাজশাহী নগরীতে তার বাড়ি।
আকাশ মজুমদার বলেন, ‘ওদের (তিন-রঙ্গা মুনিয়া) গতিবিধি বুঝে আপনি ফ্রেম ধরে বসে থাকবেন। ওরা আপনাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করাবে। কিন্তু ওরা যখন আসবে, তখন আপনাকে সময় দেবে না। হঠাৎ আসবে, দ্রুত প্রস্থান করবে। অভ্যাস ও আচরণে দারুণ অস্থির ওরা। ফলে ভালো ফ্রেমে ছবি পাওয়া চ্যালেঞ্জ।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাউনের গাছ মূলত তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট হয়। কাউন গাছে বসলে ওরা আশেপাশে দেখতে পায়। বসেই চারপাশে ঘুরে-ফিরে আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে নেয় ওরা। মাটিতে বুকে ভর করে ওদের দিকে মুভ করতে গেলেও আঁচ করে ফেলে এবং উড়ে যায়।’
স্থানীয়রা এটিকে সুন্দরী পাখি, মুনে পাখি নামে চেনে। বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) নগরীর শিমলা এলাকার পদ্মাপারে গিয়ে কাউন ক্ষেতে কথা হয় চাষি রইছউদ্দিনের সাথে। মোবাইলে পাখিটির ছবি দেখানো হলে তিনি বলে উঠেন- ‘ওহ, এটা তো সুন্দরী পাখি। অনেক পাখির মধ্যে থাকলেও চোখে পড়ে যায়। বাবুই ও চড়ুই পাখির সাথে কাউনের চাল খায়। মাঝে-মধ্যে দু’এক জোড়া দেখি।’
তিন-রঙ্গা মুনিয়া এশীয় অঞ্চলের পাখি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের দক্ষিণাঞ্চল, শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চল, জাপান ও চীনে এদের দেখা মেলে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ত্রিনিদাদ-টোবাগো, ভেনিজুয়েলা ও জ্যামাইকায়ও দেখা গেছে এদের।
বন্যপ্রাণী গবেষক সারোয়ার আলমের তথ্যমতে, তিন-রঙ্গা মুনিয়া ইংরেজি Tri-Colored Munia নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘Loxia malacca Linnaeus’। মুনিয়ার আরও পাঁচটি প্রজাতি বাংলাদেশে দেখা যায়। সেগুলো হলো- খয়রা মুনিয়া, লাল মুনিয়া, ধলাকোমর মুনিয়া, দেশি চাঁদি ঠোঁট মুনিয়া, তিলা মুনিয়া। তবে অন্য পাঁচ প্রজাতির মুনিয়ার চেয়ে সৌন্দর্যে অনন্য তিন-রঙ্গা মুনিয়া। শখের বসে অনেকে খাঁচায় পাখিটি পোষেও বলেন জানান তিনি।
পাখিটি সম্পর্কে সারোয়ার আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘চমৎকার পরিপাটি ও চোখ ধাঁধানো রঙে আচ্ছাদিত পাখি এটি। মুনিয়া সংখ্যায় কিছু কম। ওরা বাবুই পাখিদের ঝাঁকে মিশে খাবার খায়। শুধু পুরুষ তিন-রঙ্গা মুনিয়া গান গায়। প্রজননের আগে পুরুষ পাখি গায় বেশি। শান্ত স্বরে চিঁ চি শব্দে গাওয়া শুরু করে। স্ত্রী পাখিটি কাছাকাছি এলেই পুরুষ মুনিয়া স্বর জোরালো করে। শেষ অব্দি পিঁ পিঁ শব্দে রূপ নেয় মুনিয়ার ডাক।’
তিনি আরও বলেন, ‘বসন্ত ঋতু থেকে গ্রীষ্ম এদের প্রজননকাল। ৪ থেকে ৭টি ডিম পাড়ে এরা। দুই সপ্তাহ তা দিলে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে। বাবা-মা পাখি মিলে বাচ্চাকে নরম কাউন চাল, বাজরা ঘাস ও ফুলের বীজ খাওয়ায়। ১৪/১৫ দিনে পাখি উড়তে শেখে। তবে প্রায় ছয় মাস বাবা-মায়ের সাথে থাকে বাচ্চা মুনিয়ারা। তারপর জোড় বেঁধে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’
একনজরে তিন-রঙ্গা মুনিয়া:
ছোট আকারের পাখিটির ওজন হয় ১০ থেকে ১২ গ্রাম। লম্বায় ১১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখি মূলত তিন রঙে আচ্ছাদিত। মাথা, ঘাড়, গলা, বুকের কেন্দ্র, লেজের নিচের অংশ চকচকে কালো। তবে লেজের প্রচ্ছদ পোড়া কমলাও হয়ে থাকে। বুকের কেন্দ্র বাদে বাকি অংশ সাদা।
ডানা পিঠ ও লেজ কালচে খয়েরি রঙের। ঠোঁট বেশ শক্ত এবং ত্রি-কোণ আকৃতির। পায়ের পাতা, আঙুল ও নখ কুচকুচে। শক্ত শ্রেণির পাখি হলেও তিন-রঙ্গা মুনিয়া কিছুটা ঠান্ডা অসহিষ্ণু। এদের প্রজনন ক্ষমতা কম। ডাকাডাকির ক্ষেত্রে শান্ত প্রকৃতির। তবে দ্রুত গতিতে উড়তে পারে।