পাকশী রেলওয়ে বাজারের চারপাশ ঘিরে সবুজের সমারোহ। ৩০ থেকে ৩৫ প্রজাতির বৃক্ষে সুশোভিত গোটা এলাকা। যেখানে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শতবর্ষী গাছও। ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পাখির কলতান। প্রকৃতির নিয়মে বসন্তে গাছগুলো পাতা ঝরিয়ে ফের সবুজ পাতায় আচ্ছাদিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় যখন মত্ত, ঠিক সেসময় গাছগুলোর গায়ে হঠাৎ পড়েছে ‘লাল ক্রসচিহ্ন’!
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্যই কেটে ফেলা হবে গাছগুলো। সেখানে তৈরি করা হবে নিরাপত্তা বেষ্টনী। গড়ে তোলা ক্যাম্পে অবস্থান করবে প্রকল্পের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা। সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘নামমাত্র মূল্যে’ সেখানার প্রায় ১০৪ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। যা পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীনে বরাদ্দ করেছে মন্ত্রণালয়।
এদিকে, শতবর্ষী গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। তবে তারা নিরুপায়। গাছ ঠেকানোর আগে ঘর ঠেকাতে ব্যস্ত তারা। কারণ শুধু গাছই কাটা হচ্ছে না, অধিগ্রহণ করা ১০৪ দশমিক ৫০ একর জমির মধ্যে ঘরবাড়ি করে বসবাস করা মানুষগুলোকেও উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে তাদের পুনর্বাসনে নেই কোনো উদ্যোগ। ফলে মাথা গোঁজার জায়গা হারিয়ে দিশেহারা পাকশী রেলওয়ে বাজারে ‘শান্তিপুরী’র বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, রেলওয়ে বাজারের আশেপাশে বড় বড় রেইন-ট্রি, শিলকড়ই, সেগুন, মেহগনি ও শাল কাঠের গাছ রয়েছে। শুধু কাঠের গাছ নয়, সেখানে আছে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, বেল, সফেদা, কাঠবাদামের বহু সংখ্যক গাছ। এছাড়া কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কাঞ্চন, শিমুল, পলাশ ফুলের গাছও শোভা পাচ্ছে।
গাছগুলো কাটা হলে ঈশ্বরদীসহ আশেপাশের এলাকার প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। ফলে শতবর্ষী গাছগুলো না কেটে ‘নিরাপত্তা ক্যাম্প’ পরিকল্পনা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি পরিবেশকর্মী ও সাধারণ মানুষের।
জানতে চাইলে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগো ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক এএইচএম মনিরুজ্জামান মামুন বলেন, ‘প্রকল্প শুরু থেকে আমি ঈশ্বরদী এলাকার পরিবেশ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। রূপপুর প্রকল্পের কারণে এমনিতেই এলাকায় কৃষিখাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ঈশ্বরদীর বিখ্যাত লিচুর ফলন কমতে শুরু করেছে। নতুন করে গাছ উজাড় করলে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা প্রকট হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পের নিরাপত্তার খাতিরে যদি সেনা ক্যাম্প স্থাপন খুবই জরুরিও হয়ে থাকে, তবুও আমাদের অনুরোধ- প্রকল্পের অন্য কোনো পাশে জমি অধিগ্রহণ করে ক্যাম্পটি করা হোক। তাতে অন্তত গাছগুলো বেঁচে যাবে। গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখলে উন্নয়ন কাজে আহামরি কোনো ক্ষতি হবে না। বরং শতবছরের ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।’
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি- ১২০০ গাছে লাল ক্রসচিহ্ন দেওয়া হলেও তা সব কাটা হবে না। যেগুলো না কাটলেই নয়, সেগুলো কাটার পক্ষে তারা।
তবে পারমাণবিক প্রকল্প সূত্রে বলা হচ্ছে- নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরিতে ক্রসচিহ্ন দেওয়া গাছগুলো কাটতেই হবে। সঙ্গে আরও গাছ কাটার প্রয়োজন পড়তে পারে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ জানান- শিল্প মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত সভায় রেলওয়ের জমি বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বরাদ্দ পাওয়ার পর জমিটি ব্যবহার করছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প। রূপপুর প্রকল্পের লোকজন এখন সেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে চাইছে। যেহেতু জরুরি প্রয়োজনে গাছগুলো কাটতেই হচ্ছে, তাই সেটি নিয়ম মেনেই করা হবে।
তিনি বলেন, ‘আশেপাশে আমাদের (রেলওয়ে) স্থাপনাও রয়েছে। আমরা তাদেরকে বলেছি- ন্যূনতম ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকলে, সেটা দিতে। অর্থাৎ একটি গাছও যদি বাঁচানো যায়, তবে তা যেন না কাটা হয়। আমরা নজর রাখছি- যাকে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করেই কাজ করা যায়।’
জানতে চাইলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শওকত আকবর বলেন, ‘দেখুন- পারমাণবিক প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আশেপাশের বাসিন্দাদের সুরক্ষার জন্যই এটা জরুরি। বেষ্টনী তৈরির ক্ষেত্রে ঠিক যে কয়টি গাছ কাটা প্রয়োজন, তার বেশি কাটা হবে না। এতটুকু নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি।’