৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ

ঢাকা, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 14:12:40

৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্মরণকালের সুবিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। মুক্তিকামী বাঙালির কাঙ্খিত স্বাধীন বাংলাদেশের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি অক্ষর ও শব্দ। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নামের স্বপ্নের স্বদেশের বাস্তবতা মিলিত হয় একই সমান্তরালে।

জনসমুদ্রের মধ্যে আশাবাদী দ্বীপ-সদৃশ্য মঞ্চে বঙ্গবন্ধু আরোহন করেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের উতলা বাতাসে রক্তিম সূর্য তখনও মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠস্বর ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। জনতার বুকে তখন লেলিহান শিখার মতো প্রজ্বলিত একটিই মাত্র প্রত্যয় ও প্রত্যাশা: 'স্বাধীনতা'।

দরাজ গলায় ভাষণ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। তুলে ধরেন বীর বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রামশীলতার ইতিবৃত্ত। অতীতের পরিক্রমায় বর্তমানের কঠিন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি উপস্থাপন করেন জাতির ভবিষ্যত ও মুক্তির রূপকল্প। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো প্রেক্ষাপটকে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশ নামক একটি সংগ্রামময় ক্যানভাস তুলে ধরেন তিনি। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দু’টি বাক্য বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।’

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতিতে অম্লান ৭ মার্চ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেো অনন্য একটি দিন। সুদীর্ঘকালের আপসহীন আন্দোলনের চূড়ান্ত ডাক ঘোষিত হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে। সেদিন লাখ লাখ মুক্তিকামী বাঙালির উপস্থিতিতে মহান এই নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উদ্দীপ্ত ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে, প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। সংগ্রামমুখর বাঙালি স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা পেয়ে মুক্তির লক্ষ্যে উজ্জীবিত হয়। বাংলার মুক্তিকামী বাঙালি জাতি প্রতিটি ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রনিনাদে স্বাধীনতার স্পন্দনে শিহরিত হয় পুরো দেশ ও জাতি। শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় ও ঐক্যবদ্ধ প্রতীতিতে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মোহন স্পর্শে উদ্বেলিত সর্বস্তরের বাঙালি এবং বিশেষ করে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনতা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত মহান নেতা, বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণকে গণ্য করা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণে অন্যতম একটি হিসেবে, যাকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র বিশ্বেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রাজনৈতিক মহাকাব্যের দ্যোতনায় সমুজ্জ্বল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর