২০ বছর ধরে আদর-স্নেহে মেয়ে সুইটি খাতুন পূর্ণিকে বড় করেছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার ডাঙেরহাট গ্রামের শাহীন আলী।
গেল বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সামাজিক রীতি মেনে আদরের মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন পদ্মার ওপারের চরখিদিরপুরের বাসিন্দা ইনছার আলীর ২৬ বছর বয়সী ছেলে আসাদুজ্জামান রুমনের হাতে। রুমন কথা দিয়েছিল পূর্ণিকে আগলে রাখবে সারাজীবন…!
কিন্ত হায়! ২৪ ঘণ্টাও সেই কথা ধরে রাখতে পারেনি টগবগে যুবক রুমন। পদ্মার বুকে প্রেয়সী সুইটিকে খুঁইয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে এখন কাতরাচ্ছেন তিনি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে এসেছেন, কিন্তু কোথায় তার নববধূ প্রিয় পূর্ণি! সেই প্রশ্নের উত্তর জানে না কেউ-ই! যাকে মাত্র একদিন আগে আপন করে চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে নিজঘরে তুলেছিলেন রুমন।
শুষ্ক মৌসুমে বরাবরই শান্ত থাকা পদ্মা নদী শুক্রবার (৬ মার্চ) যেন ধারণ করে সর্বনাশী রূপ। ফাল্গুনের শেষ বিকেলের দমকা হাওয়ায় উত্তাল রূপে স্রোতের তোড়ে বর-কনেসহ যাত্রীবাহী দু’টি নৌকাকে গ্রাস করে পদ্মা। হই-হুল্লোড় করে নবদম্পতিকে নিয়ে ফেরা মানুষগুলো জলরাশিতে হারিয়ে যায় মূহুর্তেই। ভাগ্যক্রমে জীবন নিয়ে বেঁচে এসেছেন হাতেগোনা ক’জন। তাদের চোখে-মুখে এখনও স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ!
তাদেরই একজন সিয়াম। জেলা প্রশাসক দফতরে কর্মচারি তিনি। ঘটনার আদ্যেপান্ত জানিয়ে সিয়াম বলেন, ‘মেয়ের পক্ষ থেকে আমি গিয়েছিলাম। কনে সুইটি সম্পর্কে আমার মামাতো বোন। বরের বাড়িতে বৌভাতে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা শেষে নৌকায় ফিরছিলাম আমরা। নৌকায়ও মাঝেমাঝে গান-আড্ডা চলছিল। তখনি ঘটে যায় এসব..! সব যেন চোখের সামনে ভাসছে…!’
কনে পক্ষ যখন বৌভাত শেষে নবদম্পতিকে নিয়ে ফিরছে, ঠিক তখন কনে সুইটির ডাঙেরহাটের বাড়ি জামাই রুমনকে বরণের আয়োজনে ব্যস্ত। কনে সুইটির বাবা-মায়ের যেন তর সইছিল না। তাইতো বারবার বিভিন্নজনকে কল করে জানতে চাইছিলেন- কখন পৌঁছাবে জামাই-মেয়ে!
সেই কথাও জানালেন সিয়াম। বলছিলেন- ‘বৌভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর মামি (কনে সুইটির মা) বারবার আমার মোবাইলে কল করছিলেন। বলছিলেন- তোরা কখন আসবি, বেশি সন্ধ্যে করসি না। মাগরিবের আগেই চলে আসবি। কিন্তু আমাদের বের হতে হতে দেরি হয়ে যায়। ঠিক সন্ধ্যার আজানের পরপরই নৌকা ডুবে গেল।’
বরের পক্ষ থেকে আসছিলেন রানা। তিনি বর আসাদুজ্জামান রুমনের চাচাতো ভাই। সিয়াম ও রানা একই নৌকায় ছিলেন। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর সাঁতরে বালু তোলা ড্রেজার নৌকায় উঠে জীবন বাঁচান তারা। নিজে বেঁচে ফিরেছেন, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। কয়েকদফা বমিও করেছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রানা বলেন, ‘রুমন ভাইয়ের বিয়েতে গত দুইদিন আমাদের বাড়িতে ব্যাপক উৎসব চলছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে ঘিরে দুই পরিবারে খুশি জোয়ার বইছিল। সব নিভে গেল। কেউ কী জানতো -এমন হবে!’
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা থেকে বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা সন্ধান চালিয়ে নৌকা দু’টোরও সন্ধান পায়নি। নিখোঁজ হয়তো ১৭ জন কিংবা তারও বেশি। সন্ধানে যাদের কারও অস্তিত্ব এখনও মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে- নিখোঁজরা হয়তো কেউ-ই আর বেঁচে নেই। স্রোতে ভেসে ভাটির দিকে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চারঘাটের স্লুইসগেটে গিয়েও আটকে যেতে পারে মরদেহ।
রাত ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী সদর স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং ঝড়োবাতাসে পদ্মায় উদ্ধারকাজ চালানো ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ। সন্ধ্যার পর থেকে আমরা তৎপরতা চালিয়েছি। তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকায় উদ্ধারকাজে স্থবিরতা এসেছে। শনিবার (৭ মার্চ) ভোর থেকে ফের নিখোঁজদের সন্ধান করা হবে।’
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তার দেয়া তথ্যানুযায়ী- দুই নৌকার ৩৫ জনের অধিক যাত্রী নিখোঁজ হন। যার মধ্যে ১৮ জনকে উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে ১২ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর মরিয়ম (৮) ও রোশনি (৬) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। অন্য ১০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
শুক্রবার (৬ মার্চ) রাত যতোই বাড়ছিল, নিখোঁজদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ততোই ক্ষীণ হয়ে আসছিল। ঘটনাস্থলে আশেপাশে উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে পদ্মার শ্রীরামপুরে দুর্ঘটনাস্থলে আসেন কয়েকজন নারী-পুরুষ। জানা গেল- তাদের মধ্যে ছিল কনে সুইটির চাচী ও তাদের আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশি। তাদের গগনবিদারী আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পদ্মাপাড়। সেই আহাজারি কানে এসে ফিরছিল- ডিসি অফিসের বাঙলোর রাস্তা থেকেও!
কিন্তু লালশাড়ি পরে বউ সেজে তাদের আদরের সুইটি চুপ করে যেন লুকিয়েছে পদ্মার স্বচ্ছ জলরাশিতে। হয়তো ভাটির দিকে ভেসে যাচ্ছে তার নিথর দেহ! সঙ্গে বড় ভাই, চাচা, কচিকাচা ভাই-বোনেরাও; সকলেই এখন নিথর! হয়তো তাদের কানে বাজছেও বাবা-মা ও স্বজনদের বুকফাটা আহাজারিও..!