কোমল হাতে জুতা জোড়া দেন রামলতী

ঢাকা, জাতীয়

সাবিত আল হাসান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নারায়ণগঞ্জ | 2023-08-18 10:17:48

ফুটপাতের ওপর ছোট একটি ছাতার নিচে বসে চলছে জুতা সেলাইয়ের কাজ। শক্ত কাঠের টুকরোর ওপর জুতা রেখে মেরামত করে চলছেন এক নারী মুচি। কোমল হাতে সুঁইয়ে সুতা পেঁচিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে ছেঁড়া ফিতা জুড়ে দিলেন অনায়াসে। হাতে চলে আসল ১০ টাকা। কাজ শেষ হতেই তার খুপরির পাশে হেঁটে চলা পথচারীদের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

রামলতী রবি দাস (৬০)। জন্মসূত্রে নারায়ণগঞ্জে বসবাস। বাড়ির সামনের ফুটপাতে বসে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। পাশের একটি ভাতের হোটেলের সামনে ২ ফুট জায়গা নিয়ে নিজের আয় রোজগার চালিয়ে নেন। অথচ বছর পাঁচেক পূর্বেও এতটা করুণ অবস্থা ছিলেন না রামলতী।

আলাপচারিতায় রামলতী জানান, স্বাধীনতার পরপরেই বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর স্বামী কমল রবি দাসের সাথে শুরু করেন জুতা তৈরির ব্যবসা। স্বামী, ছেলে মেয়ে সকলে মিলেই জুতার ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। পরিবারেও ছিল বেশ স্বচ্ছলতা। ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছিলো তাদের দিন। তবে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাবার পর সকলেই আলাদা হয়ে যান।

২০১৫ সালের দিকে মারা যান ৮০ বছর বয়সী কমল রবি দাস। তার মৃত্যুর সময়েই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন তাদের দোকানের স্থলে তৈরি করে হকার্স মার্কেট। ঘোষণা দেয়া সকলকেই পুনরায় দোকান বরাদ্দ দেয়া হবে। সেখানে সবার উপরে নাম লেখান রামলতী। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার দোকানের স্থলে তৈরি হয় হোটেল। আর তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় শূন্য হাতে। বিধবা রামলতী বেশ কয়েকবার মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী কাছে দ্বারস্থ হলেও তাতে লাভ হয়নি।

তিনি বলেন, ম্যাডামের (মেয়র) কাছে কতবার গেলাম, কতবার আমার কাছ থিকা ছবি কাগজপত্র নিলো। কিন্তু দোকান আর সামনে দিলো না। দিলো একদম ভিতরে। রাস্তার লোকেরা কি মার্কেটের ভিতরে গিয়ে জুতা সেলাইবো? উনি দোকানীদের কইলো আমারে একটুখানি জায়গা কইরা দিতে। কিন্তু দোকানের লোকেরা তো আর দেয়না। তাই রাস্তাতেই বইসাই কাজ করি। বৃষ্টি আসলে ভিজ্জা যাই।

তার প্রতিবেশী জানান, রামলতী বেশ কিছু অসুখে ভুগছে। বয়স হওয়ায় মনে রাখতে পারেনা অনেক কিছুই। হাসপাতালের খরচ যোগাতে না পেরে ডাক্তার দেখান রামকৃষ্ণ মিশনে। বেশী অসুস্থ হলে আমরাই ধরে ধরে নিয়ে যাই। তার হার্টে সমস্যা সহ রক্তশূন্যতা, শ্বাসকষ্ট, প্রেশার সহ বেশকিছু রোগ রয়েছে। একা একা থেকেও সে এই বয়সে এখনও যে কাজ করে তা অবাক করার মতো।

তার সমস্যার কথা জানতে চাইলে বলেন, এখন আর আয়রোজগার হয় না। আমি মহিলা মানুষ তাই আমার কাছে জুতাও সেলাই করতেও চায় না মানুষজন। আগে জুতা তৈরিতে  আয় ভালো ছিল। এখন দিনে ২০০ টাকাও আয় আসেনা। যা আয় হয় তার বেশীরভাগ ঔষধেই চলে যায়। বয়স্ক ভাতা ৩ মাস পর পর দেয়ার কথা থাকলেও তাতে খুব একটা লাভ হয় না। কখনও তো ৬ মাস পরে পাই। সেদিকে না দেখে নিজেই কাজ করে খাওয়ার চেষ্টা করি।

তার খুপরির পাশে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া উৎসুক লোকজন বলেন, সাধারণত নারীদের মুচির কাজে দেখা যায় না। সেখানে রামলতী বৃদ্ধ বয়সে এসেও কারও কাছে হাত না পেতে নিজে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তা প্রশংসার যোগ্য। প্রতিদিনই তাকে দেখে ততটা অবাক লাগতো না। কিন্তু যখন দেখি সে ছাড়া আর কোথাও নারী মুচির দেখা পাইনা তখন তার প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে।

জীবনের এ পর্যায়ে এসে নিজের চাওয়া পাওয়া জানতে চাইলে রামলতী বলেন, আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই। ম্যাডামের কাছে (মেয়র) দোকান চাইছিলাম, কিন্তু পাইনাই। আর কারও সাহায্যও লাগবো না আমার। আমার চিন্তা হইতাছে সামনে বৃষ্টির মাস আসতাছে, কিভাবে না ভিজ্জা কাজ করুম সেইটা। যে কয়দিন বেঁচে ততদিন আছি কাজ করেই খাবো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর