‘আমাদের ঘর পোড়া আগুনে তারা আলু সেদ্ধ খায়’

ঢাকা, জাতীয়

নাজমুল হাসান সাগর, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 12:27:02

দুপুর ১২ টা, সূর্যের তীব্র তাপ। এখনও কোথাও কোথাও জ্বলছে আগুন। তবে সবকিছু মিলে আগুনে দগ্ধ রূপনগর বস্তি রূপ নিয়েছে নারকীয় ভূমিতে। আড়াই ঘণ্টার আগুনে প্রায় ৫০০ ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। আধা পোড়া টিন আর আগুনে পোড়া ছোট ছোট আধা পাকা অস্থায়ী ইটের ঘর থেকে নিজেদের শেষ সম্বল খুঁজছেন বস্তিবাসী।

বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) দুপুরে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তি সরজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়৷ এ সময় ধ্বংস স্তূপে ‘সম্বল’ খুঁজতে থাকা বস্তিবাসীকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।   

বস্তির বাসিন্দা টাইলস মিস্ত্রি মামুন বলেন, আগুন লাগে, অনেকেই আসে নাম-ঠিকানা লিখে নেন, তারপর আর কোন খবর থাকে না। আগুন লাগার পরপরই স্থানীয় কমিশনার আমাদের জন্য খিঁচুড়ি পাঠিয়েছেন। সেই খিঁচুড়ি মুখে দেওয়া যায় না। আবার অনেক সংগঠন আসে নাম লিখে নিয়ে যায় পরে আর কোন দিন তাদের দেখি না। আমরা যেমন তেমনই থাকি।

পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে জিনিসপত্র খুঁজে নিয়ে ফিরছেন বস্তিবাসী

এই ভুক্তভোগী আরও জানান, দুঃখের কথা আর কি বলবো ভাই? আগুন লাগার পরে ঘর থেকে মালামাল নিয়ে বাইরে রাস্তার ধারে রেখে, অন্য কাজে গেছিলাম। ফিরে এসে দেখি অর্ধেকের বেশি মাল চুরি হয়ে গেছে। সাহায্যের নাম করে অনেক মানুষ এখানে আসে লুটপাট করতে। ভাই, আমাগো ঘর পোড়া আগুনে তারা আলু সেদ্ধ খাইতে আইছিলো।

ঝিলের কাছাকাছি ছিল ওয়াহিদুরের ঘর। সেই পুড়ে যাওয়া ঘরের টিন এক সঙ্গে করছেন ওয়াহিদুর। তিনি জানান, আধা পোড়া টিন ও টিনের টুকরোগুলো সংগ্রহ করছেন। এগুলো ভাঙারির দোকানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবেন।

ওয়াহিদুরের মতো সব হারানো মানুষগুলো জানান, ভাঙারি ওয়ালাদের সাথে কথা বলে সর্বোচ্চ দামে পোড়া টিনগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। এখন জীবিকার জন্য এগুলোই তাদের শেষ সম্বল।

বস্তিবাসীর কাছে যখন তাদের হারানোর গল্প শুনছি- ওই সময় গোলাম রাব্বি নামে দশম শ্রেণিতে পড়া এক কিশোর আসলো। এসেই নিজের গলার কাছে একটি জখমের চিহ্ন দেখিয়ে বলল, ‘কয়েকটা গ্রুপ আইছিলো চুরি করতে। এক গ্রুপরে চুরি করতে দেইখা বাধা দিলে তারা আমারে মাইরধোর করছে। এই দ্যাহেন গলায় মাইরের দাগ’।

স্বপ্ন পোড়া ছাইয়ে হাতড়াচ্ছে বস্তিবাসী/ ছবি: শাহরিয়ার তামিম

আগুনে পোড়া রূপনগর বস্তির বিরানভূমিতে বেচে যাওয়া সম্বলটুকু খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত বিধবা কোহিনুর বেগম। কখনও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ছেন, কখনও গা-ছাড়া দিয়ে পোড়া টিন সংগ্রহ করছেন।

কোহিনুর জানালেন, আগুনে পরনের কাপড়টা ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারি নাই। মানুষের বাড়িতে বুয়ার কাজ করি আমি। দুই সন্তান নিয়া এহানে থাকতাম। আগুনে সব গেছে আমার। আগুন লাগনের পর বস্তির পাশের যত দোকান আছে সব দোকানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়া রাখছে। পাঁচ টাকার রুটি রাখে সাত টাকা, এক কাপ চায়ের দাম এখন ছয় টাকা। আমরা কই যামু তাইলে?

কোহিনুরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আল আমীন নামে এক তরুণ বলেন, কেন দেহ নাই? ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আহনের আগেই অ্যাম্বুলেন্স আইনা রাখছিলো! জানি মরলে যেনো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়া যাইতে পারে।

২৪ ঘণ্টার পার হলেও এখনও থামেনি বস্তিবাসীর কান্না

চোখে মুখে অবর্ণনীয় ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে প্রাইভেটকার চালক ওই তরুণ আরো বলেন, আমাগো বস্তিবাসীগো নিয়া সবাই ব্যবসা করে। এখানে অনেকে ইয়াবার ব্যবসা করে। অথচ যে ব্যবসা করে তারে কিছুই কয় না। আবার আগুন লাগার পরে কত জনে কত অনুদান দেয় কিন্তু টাকা পায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। গরীব নিয়া ব্যবসা করে কিন্তু গরীবের কোন সুফল নাই।

এমন শতশত বস্তিবাসী গত ২৪ ঘণ্টা অনাহার কিংবা অর্ধাহারে রয়েছে। পেটে জমানো ক্ষুধার সাথে বুকে জমানো আছে অনেক না বলা কথা। বছর বছর অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়ে বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হওয়া এসব মানুষের বুকে জমানো কথা ক্ষোভ ও ঘৃণা হয়ে বের হয়ে আসছে সময়ে সময়ে। সুযোগ পেলেই তারা বলতে চান "নিজের ঘর পোড়া আগুনে অন্যের আলু সেদ্ধ খাওয়ার" নির্মম সত্য কথা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর