রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি। বয়সে ১শ’ ৬৬ বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত ঐতিহাসিক এ লাইব্রেরিতে নেই জ্ঞানের আলো। তথ্য প্রযুক্তির যুগেও পড়ে আছে অন্ধকারে। শুধু পত্রিকা দিয়েই চলছে এ লাইব্রেরি। এক সময়ের সমৃদ্ধ রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠকের খোরাক দিনশেষে চারখানা পত্রিকা। কিছু বই থাকলেও তা পড়ার উপযোগী নয়।
প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে এ লাইব্রেরি। এ সময় আড্ডার ছলে অনেকেই আসেন লাইব্রেরিতে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কাঠের টেবিলে রাখা পত্রিকায় চোখ রাখেন। শুধুমাত্র চারখানা পত্রিকাই এখানকার প্রতিদিনের সম্বল। এজন্য একসঙ্গে চার জনের অধিক হলে সমস্যা।
পাঠকরা চাইলেও লাইব্রেরিতে বই পড়তে পারেন না। কারণ নামমাত্র এ লাইব্রেরিতে পড়ার মতো কোনো বই নেই। যা আছে সব তালা বন্দি। দুই মাস আগে লাইব্রেরির টেবিলে সাতটা পত্রিকা থাকলেও অর্থ সংকটে এখন সংখ্যা কমে তা চারে এসেছে। একটা স্থানীয় আর ঢাকা থেকে প্রকাশিত তিনটা পত্রিকা দিয়ে চলছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি।
শনিবার (১৪ মার্চ) সরেজমিনে দেখা যায়, লাইব্রেরির গায়ে ফাটল ধরেছে। দেয়ালে জমেছে শেওলা। নেই লাইব্রেরিয়ান। একজন কেয়ারটেয়ার আর পরিচ্ছন্নতা কর্মী চালাচ্ছেন লাইব্রেরির কার্যক্রম। এখনকার বিশটি আলমিরার আটটি নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো নতুনত্ব না থাকায় আলমিরার স্তুপের পুরাতন বই-পত্রিকা পাঠককে কাছে টানে না। অপর একটি অন্ধকার কক্ষে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, মাকড়সা জালে ঘিরে রাখা এক আলমিরা। আলমিরাতে সারি সারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন, জসিম উদ্দিন, আব্দুল্লাহ্ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হকসহ বহু নামী-দামি লেখকের বই। গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, জীবনী, কাব্য, সাহিত্য নির্ভর বই মিলে দেড় হাজারের কাছাকাছি বই আছে। অনেকবছর ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা বইগুলোর কোনটার- বইয়ের কভার নষ্ট কিংবা রং উঠে গেছে। কোনোটা উইপোকা খেয়েছে। আবার কোনটাতে বাসা বেধেছে।
জানা গেছে, দুই বছর ধরে বকেয়া রয়েছে এখানকার বিদ্যুৎ বিল। পত্রিকার হকারও টাকা পান লাইব্রেরির কাছে। বেতন ভাতার দৈন্য দশায় চাকরি ছেড়েছেন লাইব্রেরিয়ান। একজন কেয়ারটেকার আর পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সঙ্গে কেবল চারটি পত্রিকা নিয়ে চলছে পাবলিক লাইব্রেরি। বহু ইতিহাসের সাক্ষী রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির এমন করুণ দশায় ব্যথিত পাঠকরা। দীর্ঘ সময় ধরে কোনো সংস্কার না হওয়ায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে লাইব্রেরিটি। বর্তমানে লাইব্রেরির কোনো দাতা নেই। নেই কোনো পরিচালনা কমিটি।
সচেতন মহল ও পাঠকরা বলছেন, সংস্কার করে আধুনিকতার সঙ্গে মিল রেখে নতুন আঙ্গিকে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিকে সাজানো জরুরি। তা না হলে লাইব্রেরি বলতে আমরা যে প্রতিষ্ঠানকে বুঝি সেটার সঙ্গে বেমানান হয়ে যাবে ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিনুরাগী ডা. মফিজুল ইসলাম মান্টু বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে অনেক সরকারি গণগ্রন্থাগার হয়েছে। কিন্তু ঐতিহ্যময় পাবলিক লাইব্রেরিগুলো অযন্ত, অবহেলা, সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ নানা কারণে নষ্ট হওয়ার পথে।’
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠন শাহাদত হোসেন বলেন, ‘পাবলিক লাইব্রেরি অনেক পুরোনো পাঠাগার। এখানে মানুষ মূলত বই পড়তে আসে। সঙ্গে বোনাস থাকে পত্রিকা। কিন্তু এখন বোনাস আছে শুধু বই নেই। অথচ এখানকার বুদ্ধিজীবী মহল, উকিল, ডাক্তার, রাজনীতিবিদরা এক সময় এ লাইব্রেরিতে আসতেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এখানে পাঠক নেই বললেই চলে।’
এ ব্যাপারে লাইব্রেরির বর্তমান কেয়ারটেকার আজিজুল ইসলাম সানু বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কয়েক যুগ ধরে এখানে নতুন বই নেই। দেড় হাজারের মতো পুরাতন বই রয়েছে। তবে এগুলো পড়ার উপযোগী নয়। সংরক্ষণের অভাবে বইগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। যেসব পুরাতন পত্রিকা সংরক্ষণে রাখা হয়েছে, তার অবস্থাও খারাপ। উইপোকা, তেলাপোকা সবকিছু নষ্ট করছে। আলমিরাগুলো ভেঙে গেছে। মাকড়সার জাল, ধুলো আর ঝড়-বৃষ্টির পানিতে বই-পত্রিকাগুলো নষ্টের পথে।’
বৃদ্ধ এ কেয়ারটেকার জানান, ‘এক সময় লাইব্রেরিতে অনেক বই ও পত্রিকার পাঠক ছিল। কিন্তু এখন পাঠক কমে গেছে। জনবল নেই। লাইব্রেরির একটি হলরুম ভাড়া থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোন রকমে লাইব্রেরি খোড়ায় খোড়ায় চলছে। আগে স্থানীয় কাগজ দৈনিক যুগের আলোসহ সাতটি পত্রিকা রাখা হত। এর মধ্যে প্রথম আলো, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ, জনকন্ঠ, সমকাল, ডেইলি স্টার রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে চারটি পত্রিকা রাখা হচ্ছে।’