মান্ডা খাল এখন শুধুই স্মৃতি

ঢাকা, জাতীয়

আকরাম হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 15:35:30

রাজধানী ঢাকার এক সময়ের ঐতিহ্য ছিল খাল। ৫০টির অধিক খাল শহরজুড়ে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এসব খালের সংযোগ ছিলো চারপাশের নদীতে। বৃষ্টি হলে শহরের পানি গিয়ে পড়ত খালে, খাল হয়ে পানি চলে যেত নদীতে। সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যেতো শহরের ময়লা-আবর্জনা।

কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ভরাট, দখল আর দূষণে মৃতপ্রায় এসব খাল। যে খালগুলো এখনো বেঁচে আছে সেগুলোও দিন দিন অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। রাজধানীর খাল নিয়ে বার্তা২৪.কমের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ থাকছে মান্ডা খাল

খালে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা/ছবি:বার্তা২৪.কম

এক সময়ের খরস্রোতা মান্ডা খাল দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করত মালবোঝাই ট্রলার। খালে রাত জেগে মাছ ধরতেন জেলেরা। খালপাড়ের মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা। খাল ধরে মালবাহী ট্রলার বালু নদী হয়ে যেত শীতলক্ষ্যা নদীতে। শীতলক্ষ্যা দিয়ে ট্রলারগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেত। পূর্ব ঢাকার পানি নিষ্কাশনেও খালগুলোর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এক সময়ের খরস্রোতা মান্ডা খাল এখন শুধুই স্মৃতি। বার্তা২৪.কমের কাছে আক্ষেপ করে বলছিলেন খালপাড়ের বাসিন্দা রুহুল আমিন।

কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দখল, দূষণ, এলাকাবাসীর অসচেতনতা, সরকারি-বেসরকারি নানা অবকাঠামো নির্মাণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে মান্ডা খাল। দূষণের ফলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে আশেপাশের এলাকায়। এ খাল থেকে মশা-মাছির উৎপাত ও নানা রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। খালে ডুবে মাঝে মধ্যে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে।

আবর্জনায় খালে পানি দেখা যায় না/ছবি: বার্তা২৪.কম

মান্ডা খালটি মতিঝিল, বাংলাদেশ ব্যাংক, টিটি-পাড়া, মুগদা, মানিকনগর, মান্ডা, নন্দীপাড়া ও ত্রিমোহনী এলাকা হয়ে বালু নদীতে পড়েছে। বালু নদী থেকে গিয়ে পড়েছে শীতলক্ষ্যায়। বিভিন্ন জায়গায় এই খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কদমতলী খাল, বাসাবো খাল, জিরানি খাল, নন্দীপাড়া খাল। ঢাকা জেলা প্রশাসকের দেয়া তথ্য মতে, মান্ডা খালের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার আর প্রস্থ ৩০ থেকে ৮০ ফুট।

সরজমিনে দেখা যায়, ভরাট ও দখলের কবলে বিভিন্ন জায়গা খালের প্রস্থ কমে গেছে। কোথাও কোথাও খালের প্রস্থ ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমে এসেছে। কোথাও ময়লা জমতে জমতে ভরাট হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে খালটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় খালের বিভিন্ন অংশে কচুরিপানা, শ্যাওলাসহ ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে রাস্তা হয়ে গেছে। নিচে পানির প্রবাহ, উপরে ময়লার স্তূপ পরেছে। ময়লার স্তূপের উপর দিয়ে শিশুরা ঘুরে-বেড়াচ্ছে। কুকুর হাঁটাহাঁটি করছে। খালটিকে একটি ডাস্টবিন মনে হয়। হঠাৎ করে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না এটা একটা খাল। পানিতে বাড়ছে দুর্গন্ধ। বাড়ছে মশা-মাছি উৎপাত। ফলে এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

খালের আবর্জনার স্তুপে খেলছে শিশুরা/ছবি: বার্তা২৪.কম

খালের একপাশে বাঁধ দিয়ে রাস্তা বানানো হয়েছে। অপর পাশের বিভিন্ন অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে রিকশা গ্যারেজ, কাঁচাপাকা ঘরসহ নানা স্থাপনা। নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করতে দেখা গেছে। তাছাড়া এলাকাবাসীও অসচেতন। খালের দুই পাশের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন গৃহস্থালির আবর্জনাসহ যাবতীয় পরিত্যক্ত আসবাবপত্র এই খালে নিক্ষেপ করা হয়।

বিল্লাল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এই খাল শীতলক্ষ্যা নদীতে মিশেছে। এক সময় এই খাল দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করত। দয়াগঞ্জ, জিঞ্জিরা হয়ে বড় বড় নৌকা শীতলক্ষ্যা নদীতে চলে যেত। আমরা এই খাল দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতাম, মাছ ধরেছি। পানির কলকল শব্দ হত। সেগুলো এখন বললে মানুষ হাসবে। চোখের সামনে এই খালটা মরে গেলো।

কোথাও কোথাও খালের প্রস্থ দেড়-দুই ফুট/ছবি: বার্তা২৪.কম

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে খালটি নর্দমায় পরিণত হয়েছে। গত বছর পরিষ্কার করা হলেও তারপর থেকে আর পরিষ্কার হয়নি। এ কারণে ময়লা জমে জমে ভরাট হতে বসেছে। আর এই ময়লা-আবর্জনার কারণে শিশুরা পানিতে পড়লে তাদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। মাঝে মাঝে প্রাণহানিরও ঘটনা ঘটছে এই মান্ডা খালে।

নদী ও পানি বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’-এর মহাসচিব শেখ রোকন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ঢাকা শহরে এক সময় ৫০টির মত খাল ছিল। একটার সঙ্গে আরেকটা খালের সংযোগ ছিল। এখন ২৬টির মত খাল আছে। ঢাকা শহরের চারপাশে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু নদী। এ ছাড়াও শহরের মধ্যে আরও চার থেকে পাঁচটি নদী ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নড়াই নদী, সোনাভান নদী, দোলাই নদী ও পাণ্ডু নদী।

দখল করা হয়েছে খাল/ছবি: বার্তা২৪.কম

শহরের খালগুলো বিলুপ্তির পেছনে দুটি কারণ আছে। প্রথমত, ঢাকার নদীগুলো মেরে ফেলা হয়েছে। নদীর সঙ্গে সংযোগ না থাকায় খালগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে খালের বিলুপ্তি ঘটছে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের নামে নানা জায়গায় স্লুইসগেট দেয়া হয়েছে, বক্স কালভার্ট করা হয়েছে। তথাকথিত উন্নয়নের নামে খালগুলোকে বদ্ধ করা হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা২৪.কম-কে বলেন, সিটি করপোরেশনের নিজের কোনো খাল নেই। হাজারীবাগ খাল ওয়াসা’র অধীনে। খালের ময়লা মাঝে মাঝে পরিষ্কার করা হয়। মানুষজন আবার ময়লা ফেলে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর