দুই সপ্তাহের কানাডা সফর শেষে গত ১১ মার্চ রাতে দেশে ফেরেন রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহা. মোকবুল হোসেন। নিয়ম অনুযায়ী আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত তাকে হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার কথা। কিন্তু কিছুতেই বাড়িতে সঙ্গরোধ (হোম কোয়ারেন্টাইন) মানছেন না বোর্ড চেয়ারম্যান। দেশে ফিরেই তিনি বসেছেন শিক্ষাবোর্ডে নিজ কার্যালয়ে। অংশ নিয়েছেন একের পর এক আলোচনা সভা, কেককাটা ম্যুরাল উদ্বোধন এমনকি প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানেও।
ফলে তার সংস্পর্শে এসেছেন ওই সব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনসহ জেলার ভিআইপি ব্যক্তিরাও। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর রাজশাহী জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে তাকে কড়া ভাষায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে কানাডা সফরে যান শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোকবুল হোসেন। সফর শেষে দেশে ফেরেন ১১ মার্চ রাতে। রাজশাহীতে ফিরে ১৫ মার্চ শিক্ষাবোর্ডে নিজ দফতরেও বসেন তিনি। ১৬ মার্চ রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন।
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী সিটি করপোরশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। অতিথি ছিলেন শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান তানবিরুল আলম, রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমান, রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এস.আর তরফদার প্রমূখ।
পরদিন ১৭ মার্চ রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কেককাটা, ম্যুরাল উদ্বোধন, আলোচনা সভা ও প্রীতিভোজেও অংশ নেন কানাডাফেরত অধ্যাপক মোকবুল। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মেয়র লিটন। অতিথি ছিলেন শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান তানবিরুল আলম, আবুল হায়াত, বোর্ড সচিব, রাসিকের প্যানেল মেয়র, চারজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ কয়েক’শ মানুষ।
বিষয়টি নিয়ে জানতে অধ্যাপক মোকবুল হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘আমি সব মেনে চলছি। দেশের আসার পর বাইরেই বের হয়নি।’ বোর্ডে অফিস করা এবং রাসিক মেয়রের সঙ্গে প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার ছবি আছে জানালে বক্তব্য পাল্টে যায় বোর্ড চেয়ারম্যানের। তিনি বলেন, ‘ওটা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ছিল, তাই গিয়েছিলাম।’
নির্দেশনা মেনে না চলা উচিত কিনা প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘খুব বোঝাতে আসছেন আপনি? কী করত হবে এসে আমাকে বলে দিয়ে যান।’
এদিকে, সঙ্গরোধ মানছেন না রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা জিএম মোর্তুজাও। এক সপ্তাহের সফর শেষে গত ১০ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে ১৫ মার্চ রুয়েটে নিজ দফতরে অফিস করেন মোর্তুজা। অংশ নেন রুয়েটে ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও। যেখানে রুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখসহ, রেজিস্ট্রার, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, শিক্ষক ও কর্মকর্তা নেতৃবন্দও উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া তার মালিকানাধীন ‘রেডিও পদ্মা’র সহযোগিতায় প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের আয়োজনে কমিউনিটি রেডিও বিষয়ক ট্রেইনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গেও সভা করেন জিএম মোর্তুজা। গত ১৫ মার্চ ৩৫ জন ট্রেইনিকে নিয়ে রেডিও পদ্মা অফিসে ট্রেনিং বিষয়ে ঘণ্টাব্যাপী ব্রিফ করেন তিনি।
তবে জিএম মোর্তুজা দাবি করেন, ‘দেশে ফিরে জাস্ট জয়েন করতে অফিসে গিয়েছিলাম। আমি সেভাবে বের হইনি।’
এদিকে, শিক্ষাবোর্ড চেয়রম্যান ও রুয়েট জনসংযোগ কর্মকর্তা নিজেদের ‘ট্রাভেল হিস্ট্রি’ গোপন করে সঙ্গরোধ (কোয়ারেন্টাইন) না মানার বিষয়টি জানাজানি হলে ক্ষোভ জানিয়েছেন তাদের সংস্পর্শে আসা একাধিক ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষ। নাম প্রকাশ না করে তারা জানান- দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি এমন অদায়িত্বশীল আচরণ করে, তবে সমাজের সাধারণ মানুষ কীভাবে শিখবে। তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের সমালোচনা করেন তারা।
জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান সঙ্গরোধ (কোয়ারেন্টাইন) মানছেন না বিষয়টি জানার পর তাকে কড়া ভাষায় নিয়ম মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বাকি সময় কোয়ারেনটাইন মেনে চলবেন বলে আমাদের নিশ্চিত করেছেন।’ রুয়েট জনসংযোগ কর্মকর্তার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না জানিয়ে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। যদি তিনি বিদেশ সফর করে এসে থাকেন, তবে তাকে অবশ্যই হোম কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে।’
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. গোপেন্দ্রনাথ আচার্য্য বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান যেটি করেছেন, তা একেবারে উচিত নয়। কারণ তার সংস্পর্শে যেসব ব্যক্তিরা এসেছেন, তারাও এখন এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেল। তার সাথে যোগাযোগ হয়েছে, তিনি এখন থেকে সব নিয়ম মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন।’
ড. গোপেন্দ্রনাথ আচার্য্য জানান, শনিবার (২১ মার্চ) পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগের আট জেলা বিদেশফেরত ১৭২৪ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে এখন সঙ্গরোধে (কোয়ারেন্টাইন) আছেন ২২৪ জন। আর জয়পুরহাটে একজনকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। রাজশাহী জেলায় বিদেশফেরত রয়েছে ১২৭৩ জন। আর জেলায় ২২ জন বাড়িতে সঙ্গরোধে (কোয়ারেন্টাইন) আছেন। তবে এখনও বিভাগের আট জেলায় কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি বলেও জানান তিনি