আদালতে ‘মিথ্যা’ হলফনামা দিয়ে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন রাজশাহী সীমান্তে অনুপ্রবেশের দায়ে দুই মামলার বিচারাধীন আসামি ভারতীয় জেলে প্রণব মন্ডল। তাকে জামিন করাতে আত্মীয় পরিচয়ে আদালতে হলফনামা দিয়েছেন রাজশাহীর চারঘাটের নিতাই মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি। অথচ তাতে স্বাক্ষর করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম।
এছাড়া জামিনের শর্তে তাকে মামলার বিচার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চারঘাটে আত্মীয় নিতাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করার কথা। কিন্তু জামিন পেয়েই পরদিন দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান প্রণব। তবে পুরো ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানে না বিজিবি। বিজিব ও চারঘাট থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী প্রণব এখন ‘নিখোঁজ’।
তার জামিনদাররা বলছেন- ‘প্রণব বাংলাদেশে আর আসবে কিনা সেই নিশ্চয়তা তাদের কাছে নেই।’ আর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন- ‘মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভুয়া আত্মীয় পরিচয়ে জামিনদার হয়েছেন চারঘাটের নিতাই ও রহিম।’
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেলা সুপার গিয়াস উদ্দিন বলেন, গত ১৭ মার্চ প্রণব মণ্ডলের জামিন আবেদন করেন আইনজীবী ইন্তাজুল হক। ওইদিন তিনি একটি মামলায় জামিন পান। পরে ২২ মার্চ অপর মামলায় আদালত তাকে জামিন দেয়। ২৩ মার্চ আদালত থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাকে জামিন করাতে চারঘাটের ইউসুফপুরের নিতাই মণ্ডল আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আদালতে হলফনামা দেন। তবে জামিননামায় স্বাক্ষর করেন ইউসুফপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর আব্দুর রহিম। জামিনের শর্তে তাকে মামলা চলাকালে আত্মীয় নিতাই মণ্ডলের বাড়িতে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়।
এদিকে, ২৫ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকা প্রণবের একটি সাক্ষাতকার প্রকাশ করে। সেখানে প্রণব জানান, ২৪ মার্চ রাতে তাকে চারঘাটের ইউসুফপুর সীমান্ত দিয়ে রাতে সীমান্ত পার করে দিয়েছেন একজন দালাল। সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি বিএসএফের কাগমারী সীমান্ত ফাঁড়িতে চলে যান। সেখান থেকে বিএসএফ সদস্যরা ২৫ মার্চ ভোরে তাকে গাড়িতে করে জলঙ্গি থানার শিবচর গ্রামে নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেন।
আনন্দবাজারে খবর প্রকাশের পর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হন রাজশাহীর বিজিবি কর্মকর্তারা। বিজিবি-১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফেরদৌস জিয়াউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এটা শঙ্কার বিষয়। কারণ ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যদি এখন আমাদের কাছে প্রণবের খোঁজ চায় সেক্ষেত্রে আমরা জবাব দিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবো।’
তিনি বলেন, ‘প্রণবের জামিনের পর জামিননামায় স্বাক্ষর করা ব্যক্তির কাছে তাকে বাংলাদেশেই থাকার কথা। কিন্তু তিনি গোপনে পালিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।’
চারঘাট থানার ওসি সমিত কুমার কুন্ডু বলেন, ‘জামিন নিয়ে প্রণব মণ্ডলের থাকার কথা ছিল নিতাই মণ্ডলের বাড়িতে।তবে তিনি এখন নিখোঁজ। আমরা তার খোঁজ-খবর নিচ্ছি।’ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরের বিষয়টি অবগত করলে ওসি বলেন, ‘সেটা আমরাও শুনছি। তবে আমাদের হিসেব অনুযায়ী প্রণব মণ্ডল এখন নিখোঁজ।
এদিকে, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন ভারতীয় জেলে প্রণবের জামিনে আদালতে হলফনামা দেয়া নিতাই মণ্ডল। আর জামিননামায় স্বাক্ষর করা ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম বলেন, ‘নিতাই আমাকে অনুরোধ করায় আমি স্বাক্ষর করেছি। আমি প্রণবকে চিনি না। সে আর বাংলাদেশে ফিরবে কিনা তাও বলতে পারবো না।’
জানা যায়, গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজশাহীর চারঘাট সীমান্তে জলসীমা দিয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে তিন জেলেকে গ্রেফতার করে বিজিবি। তাদেরকে ছাড়াতে বিএসএফ সদস্যরা অনুমতি ছাড়াই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং জোর করে অচিন্ত মণ্ডল ও বিকাশ মণ্ডল নামে দুই জেলেকে ছাড়িয়ে নেয়।
তবে প্রণবকে ছাড়াতে না পেরে তারা বিজিবি সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। বিজিবি আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুঁড়লে বিএসএস’র হেড কনস্টেবল বিজয় ভানু সিংহ নিহত হন। আহত হন আরও দুই বিএসএফ সদস্য।
ঘটনার পরদিন রাতে চারঘাট বিজিবি ফাঁড়ির হাবিলদার হুমায়ন কবীর বাদী হয়ে প্রণব মণ্ডল, অচিন্ত মণ্ডল, বিকাশ মণ্ডল ও অজ্ঞাত বিএসএফ সদস্যসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ এবং বিজিবির ওপর গুলিবর্ষণের অভিযোগে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১৮ অক্টোবর আদালতের মাধ্যমে প্রণবকে কারাগারে পাঠানো হয়। গেল বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রণব মণ্ডলসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে দুই মামলায় চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।