আমাদের দেশে জীবাণুনাশক হিসেবে ক্লোরহেক্সিডিন গ্লুকোনেট (স্যাভলন অ্যান্টিসেপটিক/ডিসইনফেক্ট্যান্ট সল্যুশনের মূল উপাদান), বেঞ্জালকোনিয়াম ক্লোরাইড (লাইজল এবং ডেটল ডিসইনফেক্ট্যান্ট সল্যুশনের মূল উপদান) এবং ক্লোরজাইলেনল (ডেটল অ্যান্টিসেপটিক সল্যুশনের মূল উপাদান) খুব পরিচিত হলেও, ব্লিচ দ্রবণ খুব একটা পরিচিত নয়।
ক্লোরহেক্সিডিন গ্লুকোনেট, বেঞ্জালকোনিয়াম ক্লোরাইড এবং ক্লোরজাইলেনলের মতোই ব্লিচ অত্যন্ত কার্যকরী পৃষ্ঠ জীবাণুনাশক (disinfectant)। ভাইরাসের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকরী বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আমেরিকান সিডিসি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্লিচ দ্রবণ ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি পত্রিকায় ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে কীভাবে ১ : ১০ এবং ১ : ১০০ মাত্রার জীবাণুনাশক দ্রবণ বানানোর যে পদ্ধতি প্রকাশিত হয়েছে, তা সঠিক নয়। এসব প্রতিবেদনে কার্যকরী ব্লিচ দ্রবণ বানাতে যে পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত পরিমাণের সাথে মেলে না বরং সেটা ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের পাউডার বা হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইটের সাথে মিলে যায়।
উল্লেখ্য, তিন ধরনের উপদান দিয়ে জীবাণুনাশক ব্লিচ দ্রবণ তৈরি করা যায়- তরল ব্লিচ, ব্লিচিং পাউডার এবং ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের সাদা পাউডার বা হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইট। কার্যকরী জীবাণুনাশক ব্লিচ দ্রবণ তৈরিতে এ তিনটির যে কোনো একটি ব্যবহার করা যায়, কিন্তু এদের একেকটিতে ক্লোরিনের ভাগ একেক রকম এবং এরা রাসায়নিকভাবেও আলাদা। তাই জীবাণুনাশক ব্লিচ দ্রবণ তৈরিতে এদের ব্যবহার্য পরিমাণ অনেক কমবেশি হয়। আর, কার্যকরী জীবাণুনাশক ব্লিচ দ্রবণের ঘনমাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার লেখার উদ্দেশ্য এই ব্যাপারটি খোলাসা করা।
তরল ব্লিচ হলো সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের (রাসায়নিক সংকেত NaClO) একটি জলীয় দ্রবণ। এটি সাধারণত ৫-৬% জলীয় দ্রবণ আকারে বাজারজাত করা হয়। আমাদের দেশে লিকুইড ব্লিচের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। দারাজ, চালডাল.কম, মিনাবাজার ইত্যাদি অনলাইন শপে এটি ক্লোরক্স (clorox) নামে কিনতে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, ব্লিচিং পাউডার (বা ক্লোরিনেটেড লাইম) হলো সাদা রঙের এক ধরনের পাউডার যা ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড [Ca(OH)2], ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড [CaCl2] এবং ক্যালসিয়াম হাইপোক্লরাইটের [Ca(ClO)2] মিশ্রণ। ব্লিচিং পাউডার থেকে ২০-৩৫% ক্লোরিন পাওয়া যায়। লিকুইড ব্লিচের মতো ব্লিচিং পাউডারও জীবাণুমুক্ত করতে বাথরুমে, ড্রেনে, সুইমিং পুলে, পানিতে গুলিয়ে জীবাণুনাশক স্প্রে তৈরিতে, খাবার পানি জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়। ব্লিচিং পাউডারের ক্যালসিয়াম হাইপোক্লরাইট মূলত জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে।
ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের সাদা পাউডার বা হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইট অন্যান্য সহযোগী উপাদান থাকে না। এটি থেকে প্রায় ৭০% ক্লোরিন পাওয়া যায়। তাই, জীবাণুনাশক হিসেবে সাধারণ ব্লিচিং পাউডারের তুলনায় ক্যালসিয়াম হাইপোক্লরাইটের পাউডার বা হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইটের অনেক বেশি শক্তিশালী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, তরল ব্লিচ, সাধারণ ব্লিচিং পাউডার এবং হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইট পাউডার দিয়ে বিভিন্ন ঘনমাত্রার ব্লিচ জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির সঠিক পদ্ধতি এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহার নিচে আলোচনা করা হলো।
ক) তরল ব্লিচ বা সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের জলীয় দ্রবণ দিয়ে জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির পদ্ধতি:
তরল ব্লিচ দিয়ে জীবাণুনাশক দ্রবণ বানাতে অবশ্যই ব্লিচের বোতলের গায়ে লেবেল দেখে নিতে হবে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট কত ভাগ (%) রয়েছে। সাধারণত তরল ব্লিচে ৫-৬% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট থাকে। এর কমও থাকতে পারে। তাই নিশ্চিত হয়ে নিন এবং নিচের তালিকা অনুযায়ী তরল ব্লিচের সাথে পানি মিশিয়ে নিন।
I. ১ : ১০ ব্লিচ দ্রবণ (খুবই শক্তিশালী) তৈরি করতে ৯.৯ লিটার পানিতে ১০০ মিলি লিটার তরল ব্লিচ (যাতে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের মাত্রা প্রায় ৫%) মিশিয়ে ভালোভাবে নেড়ে বালতি বা যে পাত্রে বানানো হচ্ছে তা বন্ধ করে দিতে হয়। কিছুক্ষণ পর উপর থেকে পরিষ্কার দ্রবণটি ঢেলে নিতে হয়। কারণ, নিচে অদ্রবণীয় সহযোগী পদার্থগুলোর তলানি পড়ে, যা সরিয়ে ফেলা বাঞ্ছনীয়।
এ দ্রবণটি যেসব কাজে ব্যবহার করা যাবে তা হলো: মলমূত্র, লালা, কফ, বমি, গাড়ির টায়ার ইত্যাদি যেসব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে জীবাণু থাকতে পারে, সেসব জীবাণুমুক্ত করতে। এটি মূলত হাসপাতালে ব্যাবহার করা হয়।
II. ১ : ৫০ ব্লিচ দ্রবণ (মধ্যম শক্তিশালী) ব্লিচ দ্রবণ বানাতে ২০ মিলি লিটার তরল ব্লিচ ৯৮০ মিলিলিটার পানির সাথে মেশাতে হয়। এ দ্রবণটির ব্যবহার ১ : ১০ ব্লিচ দ্রবণের মতো।
III. ১ : ১০০ ব্লিচ দ্রবণ (কম শক্তিশালী) বানাতে ১০ মিলি লিটার তরল ব্লিচ ৯৯০ মিলিলিটার পানির সাথে মেশাতে হয়। এ দ্রবণটি বাসায় ঘরের মেঝে এবং রান্নাঘর জীবাণুমুক্ত করা, বাচ্চাদের প্লাস্টিক খেলনা জীবাণুমুক্ত করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। হাসপাতালে এটি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, রোগীর ব্যবহৃত বিছানা, ডাক্তারদের পুনরায় ব্যবহারযোগ্য অ্যাপ্রন, গ্লাভস, জুতা ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করা যায়।
খ) ব্লিচিং পাউডার পাউডার দিয়ে জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির পদ্ধতি:
ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরি করতে প্যাকেটের বা কন্টেইনারের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ে নিতে হবে। এটি সাধারণ ব্লিচিং পাউডার না ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের পাউডার, তা নিশ্চিত হয়ে এক লিটার পানিতে ১ : ১০ এবং ১ : ১০০ মাত্রার দ্রবণ তৈরিতে কতোটুকু পাউডার মেশাতে হবে তা বের করতে হবে।
I. ১: ১০ মাত্রার জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির জন্য এক লিটার পানির সঙ্গে ১৬ গ্রাম (এক টেবিল চামচ) ব্লিচিং পাউডার যোগ করতে হবে। এরপর পানির সঙ্গে মেশার জন্য আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। কিছুক্ষণ পর উপর থেকে পরিষ্কার দ্রবণটি ঢেলে নিতে হবে।
II. ১: ১০০ মাত্রার জীবাণুনাশক তৈরির ক্ষেত্রে ১০ লিটার পানির সঙ্গে ১৬ গ্রাম (এক টেবিল চামচ) ব্লিচিং পাউডার যোগ করতে হবে। পানিতে ব্লিচিং পাউডার যাতে ভালোভাবে মিশতে পারে, সে জন্য আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। কিছুক্ষণ পর উপর থেকে পরিষ্কার দ্রবণটি ঢেলে নিতে হবে।
গ) ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের পাউডার বা হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইট দিয়ে জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির পদ্ধতি:
ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের পাউডার বা হাই টেস্ট হাইপোক্লোরাইটে প্রায় ৭০% ক্লোরিন পাওয়া যায়, তাই ১ : ১০ এবং ১ : ১০০ দ্রবণ তৈরিতে এর পরিমাণ সাধারণ ব্লিচিং পাউডারের তুলনায় অনেক কম লাগে।
I. ১: ১০ মাত্রার জীবাণুনাশক দ্রবণ তৈরির জন্য এক লিটার পানির সঙ্গে ৭ গ্রাম (১/২ টেবিল চামচ) ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের পাউডার যোগ করতে হবে। এরপর পানির সঙ্গে মেশার জন্য আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
II. ১: ১০০ মাত্রার জীবাণুনাশক তৈরির ক্ষেত্রে ১০ লিটার পানির সঙ্গে ৭ গ্রাম (১/২ টেবিল চামচ) ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটের পাউডার যোগ করতে হবে। পানিতে পাউডার যাতে ভালোভাবে মিশতে পারে, সে জন্য আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
তবে, জীবাণুনাশক ব্লিচ দ্রবণ তৈরি এবং ব্যবহারের আগে তিনটি পয়েন্ট অবশ্যই মনে রাখতে হবে:
১। ব্লিচ দ্রবণ শুধুমাত্র কোনো প্রাণহীন/জড় বস্তুকে (যেমন- আক্রান্ত রোগীর বিছানা, কাপড়চোপড় ইত্যাদি) বা জড় বস্তুর পৃষ্ঠকে (ঘরের মেঝে, রান্নাঘর, হাসপাতালের মেঝে, যন্ত্রপাতি, দরজার হাতল, যানবাহন, সিঁড়ির রেইলিং ইত্যাদি) জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বিকল্প নয়। মানুষের ত্বকের জন্য ব্লিচ মারাত্মক ক্ষতিকারক।
২। সব ব্লিচ দ্রবণই সব সময় ফ্রেশ বানানো ভালো, কারণ সময়ের সাথে সাথে এর কার্যক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায়। এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবহার করা উত্তম।
৩। স্প্রে হিসেবে ব্যবহার করলে খুব সাবধান হতে হবে, যাতে এটি নাকে এবং চোখে প্রবেশ না করে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আসুন সবাই সচেতন হই। সরকারের নির্দেশনা মেনে চলি।
ড. মো. আজিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (ajijur.rubd@gmail.com)