মানুষের গিজগিজে ভিড়। একজনের গায়ে লেপ্টে আছে আরেকজন। এভাবে মানুষের দীর্ঘ সারি। সবার চোখ সামনে থাকা মাঝারি একটি ট্রাক ঘিরে। ট্রাক থেকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার জন্য লাইনে হাজারো মানুষ।
হই হুল্লোড়ের মধ্যে কারো খেয়াল নেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখার কথা। নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব রাখার জন্য সরকার যখন মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে, স্বল্প মূল্যে খোলাবাজার থেকে চাল কিনতে তখন সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে গত কয়েকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে এমন চিত্র।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের এক পাশে যখন শুনশান নীরবতা, ঠিক অন্য পাশে তখন ১০ টাকা কেজি দরে চাল কিনতে আসা মানুষের হুড়োহুড়ি।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যু। কিন্তু সেদিকেও হুঁশ নেই যেন কারো।
এ পরিস্থিতির জন্য স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি আর পরিকল্পনার অভাবকে দুষছেন সাধারণ নাগরিকরা। তারা বলছেন, প্রশাসনের চোখের সামনেই এভাবে ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে গায়ে গা ঘেঁষে ভর্তুকি মূল্যে চাল সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য।
সাভারের সংসদ সদস্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সতর্কবার্তা- দয়া করে এভাবে জনসমাগম ঘটিয়ে মহামারি করোনাভাইরাসকে কেউ আমন্ত্রণ জানাবেন না।
কিন্তু কেউ আমলে নেয়নি এই সতর্কবার্তা। এমনকি প্রশাসনের তরফেও দেখা যায়নি কোনো পদক্ষেপ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খোলাবাজারে চাল বিক্রি এ কর্মসূচি ঘিরে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অনেকের কপালে।
স্থানীয়রা বলছেন, খোলাবাজারে চাল বিক্রির কাজে নিয়োজিত ডিলারদের এখন রমরমা ব্যবসা। তারা ব্যবসার বিষয়টিই ভাবছেন। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নাগরিকদের নিরাপত্তায় সরকারি নির্দেশনা মানার বিষয়ে তাদের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডিলার বলেন, আপৎকালীন ঝুঁকি নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছি। জনগণকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হাজার বার বলা হলেও তাতে কেউ কর্ণপাত করছে না। আমাদের সামর্থ্য কতটুকু? প্রশাসন যদি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আমার কি করার আছে?
১০ টাকা কেজি দরে খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল কিনতে প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে এসেছেন মাটি কাটা শ্রমিক রোকসানা বিবি (৪৫)।
দেশে কী একটা রোগ আইছে। কী ভাইরাস জানি মনে নাই। তাই কাজকাম বন্ধ। কারো কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই নাই। ঘরে তেমন টাকা পয়সাও নাই। তাই চাল কিনতে এতদূর থন আইসি। তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ায়াও চাল পাই নাই, বলছিলেন রোকসানা বিবি।
কথা হয় লাইনে দাঁড়ানো রিকশাচালক ছমির আলীর সাথে।
গাদাগাদির মধ্যে দাঁড়িয়েই তিনি বলছিলেন, গরিবের পেটের ক্ষিধা হইল আসল রোগ। পেটের ক্ষিধায় তো মরতাছি, কেউ দেখে না। আগে ক্ষিধা থাইক্যা বাঁচান। তারপরে বাঁচান ভাইরাস থাইক্যা।
ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে গাদাগাদি করে খোলাবাজারে চাল বিক্রির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন সাভার প্রেসক্লাবের সভাপতি নাজমুস সাকিব। তিনি বলেন, গাদাগাদি করে চাল কেনার এ প্রতিযোগিতা আমাদের সাধারণ নাগরিকদের জন্য এক অশনিসংকেত। রেশন কার্ড চালু করা এখন সময়ের দাবি। করোনার আপৎকালে টিসিবি'র (ট্রেড কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) মাধ্যমে পণ্য বিক্রি নয়, দ্রুত রেশন কার্ড তৈরি করুন। প্রয়োজনে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় খাদ্যের সন্ধানে ক্ষুধার্ত মানুষের জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। এ জনস্রোত আমাদের মৃত্যুর মিছিলে নিয়ে দাঁড় করাতে পারে। যা সবার জন্যই বিপদজনক।
রেশন কার্ড হলে সুষম বন্টন হবে এবং চাল চুরির ঘটনাও কমে যাবে। এছাড়া করোনাভাইরাস গণসংক্রামণের ঝুঁকিও কমে যাবে, যোগ করেন নাজমুস সাকিব।
মহামারি করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী লাগোয়া জনপদ সাভার। যে কারণে গোটা সাভার-আশুলিয়া জুড়েই আতঙ্ক। জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথার মত কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ নিয়ে এরই মধ্যে ১৫ জন করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা করিয়েছেন।
এদের মধ্যে নয়জনের রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও এখনো হাতে রিপোর্ট না আসায় নমুনা সংগ্রহ করা অন্যদের পরিবারকে কার্যত রাখা হয়েছে লকডাউনে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে গাদাগাদি করে চাল বিক্রির ঘটনা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে মনে করেন সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সায়েমুল হুদা।
বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, বাস্তবিক অর্থে তার চোখের সামনে এভাবে চাল বিক্রি তিনি নিজেও দেখেছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লক্ষ্য করেছেন, সাধারণ মানুষের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এভাবে আমরা করোনাভাইরাসকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি না। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে কঠোর না হলে নিশ্চিত আমাদের অশুভ পরিণতি বরণ করতে হবে।