‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-26 04:36:30

‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, সারা পৃথিবীর কাছে বলব, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবার জন্য’।- যে মেয়েটা আগুনে পুড়তে পুড়তে কথাগুলো বলে গেছে, আজ মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু যে প্রতিবাদের মশাল মেয়েটা ফেনীসহ সারা বাংলাদেশের নারী জাগরণের বহ্নি শিখা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে তা আজও নেভেনি। তাই বোধ করি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম, তুমি রবে নীরবে, নবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম তুমি রবে নীরবে...।”

ফেনীর সোনাগাজীতে বহুল আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের একবছর পূর্ণ হলো। ২০১৯ সালের এ দিনে (১০ এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।  করোনাভাইরাস সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তার মৃত্যু দিনে কোন স্মরণসভা বা শ্রদ্ধা নিবেদেনের আয়োজন করা না হলেও ফেনীর মানুষের সমবেদনা এ মেয়েটার প্রতি চিরকাল থাকবে।

পিবিআই এর স্কেচে নুসরাত হত্যার সচিত্র বিবরণ

২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষাকেন্দ্রের ছাদে পুড়িয়ে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে, ৮ এপ্রিল তার ভাই থানায় মামলা করে। তারও আগে ২৭ মার্চ যৌন হয়রানির শিকার হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করে নুসরাতের মা শিরীন আক্তার। পরদিন আটক করে তকারাগারে প্রেরণ করা হয় তাকে। কারাগার হতেই হত্যার নীল নকশা তৈরি করে সিরাজ-উদ-দৌলা।

ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ মামলার রায় দেন গত বছরের ২৪ অক্টোবর। চার্জশিটভূক্ত ১৬ অভিযুক্তের সবার ফাঁসির রায় দেন, সাথে এক লাখ টাকা করে দণ্ড।

বাদীপক্ষের আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু জানান, অভিযোগ গঠনের পর মাত্র ৬২ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক গ্রহণের পর রায় প্রদান করা হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিশেষ ভূমিকার জন্য বিচারক সাধুবাদ জানান গণমাধ্যমকর্মী ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে।

রায়ের দিন আদালতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা

এ হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভে উত্তাল হয় সারাদেশ। ফেনী যেন আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ। সারাদেশ মিছিল, মিটিং, স্লোগানে প্রকম্পিত। দৃষ্টি এড়ায়নি প্রধানমন্ত্রীর। কঠোর ভাষায় বিচারের ঘোষণা দিলেন, নুসরাতের পরিবারকে কাছে টেনে নিলেন। বললেন, অপরাধী যেই হোক, ক্ষমা নয়। বিচার হলো, তবে নুসরাত রেখে গেল উদাহরণ। অন্যায়ের কাছে মাথা নত নয়, পিছপা নয়। একটি চিঠিতে নিজের জীবন দিয়ে হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদের ঘোষণা করেছিলেন।

নুসরাত জাহান রাফি নৃশংস হত্যাকাণ্ড বছর পেরিয়ে গেলেও অমলিন রয়ে গেছে ফেনীর মানুষের মনে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনও উচ্চারিত হয় নুসরাতের নাম, বিচারের দ্রুততার মাইলফলক হয়ে।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ফাওজিয়া আবিদা বলেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ড নারীর নিরাপত্তার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত তাই আমি ভীত। নুসরাত হত্যার কঠোর রায় আমায় সাহসী করেছে, প্রতিবাদী হয়ে শিখিয়েছে।

মা ভুলেননি কোনোকিছুই। এখনও কাঁদেন আগের মতো, যেখাবে একবছর আগে কেঁদেছেন। তিনি বলেন, এক বছর হয়ে গেলেও এখনো দু’চোখ এক করলেই ভেসে উঠে মেয়ের মুখ। উচ্চ আদালত পানে তাকিয়ে থাকা শিরীন আক্তার বলেন, আমরা উচ্চ আদালতের দিকে চেয়ে আছি, আশা করছি আসামিদের ফাঁসির রায় বহাল রাখবে।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ওন্যায় বিচারের আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্র  শেখ হাসিনা

হত্যা মামলার বাদী ও নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, ‘আমরা প্রথমে ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি চেয়েছেন বলেই এত দ্রুত নিম্নআদালত থেকে সুবিচার পেয়েছি। আমারা জানতে পেরেছি মামলাটি উচ্চ আদালত থেকে নিষ্পত্তির বিষয়েও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আশা করি সেখানেও আমরা সুবিচার পাবো, সকল আসামির ফাঁসি কার্যকর হবে।

নুসরাত হত্যাকাণ্ডে ফেনীকে ভিন্নরূপে দেখেছেন সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মোতালেব। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ফেনীর সকল স্তরের মানুষ এক কাতারে চলে আসে। রাজনৈতিক দল, সুধীজন, বনিক, সাংবাদিক, শিক্ষক সবাই সমস্বরে বিচারের দাবী তুলেছিল। প্রমাণিত হল ফেনীর মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার।

নুসরাত হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা

নুসরাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

মা ও ছোটা ভাইয়ের সাথে নুসরাত। ছবিটি এখন কেবল স্মৃতি

রায়ের পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে এডভোকেট শাহজাহান সাজু বলেন, নিম্নআদালতের রায়ের পর ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিলো। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল বিভাগ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

নুসরাতের মৃত্যুর পর তার বাবা মাওলানা মুসা আহাজারি করে বলেছিলেন,  ঘরবাড়ির আগুন দেখা যায়, মনের আগুন দেখা যায় না। যে ফুটফুটে কিশোরী আর ইহপৃথিবীর নীল আকাশ দেখবে না, হাত ভরে রেশমি চুড়ি পরবে না, সে যে বলে গেছে আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলবো?

বীন্দ্রনাথের গানের সেই গানের শেষ লাইন “মম দুঃখবেদন, মম সফল স্বপন মম দুঃখবেদন”। তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর